প্রেমের নয়, আগুনের সর্বনাশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এই চৈত্রে। বনানীর বহুতল ভবনের অগ্নিরথ থামতে না থামতেই আগুনের তাণ্ডবে পুড়েছে পাশের গুলশান এলাকার আস্ত মার্কেট। এবং তারপর গুলশানেরই একটি বিমা অফিস।
ফাল্গুন পেরিয়ে বসন্ত ঋতুর দ্বিতীয়-পর্ব চৈত্র মাসের মাঝামাঝি চলছে এখন। কবিগুরু বলেছিলেন, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ চৈত্রের প্রখর খরদাহ ও ঝড়ের তাণ্ডবতায় ব্যক্তিগত প্রেমের সর্বনাশ ছাড়িয়ে সামাজিক সর্বনাশের অগ্নিময় বাঁশি কখন যে বেজে ওঠে, কে জানে! প্রশ্ন উঠেছে, এগুলো দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? আমাদের জীবনে প্রচণ্ড চৈত্রের সর্বনাশা তাণ্ডবের শেষ কোথায়?
লক্ষ্য করা গেছে, এ বছর ফাল্গুনী বাহারে-চঞ্চল মধ্য ও শেষ দিনগুলোতেই থাবা হেনেছে চৈতালী উন্মত্ততা। ঝড়ো হাওয়ায় শিলা বৃষ্টি তছনছ করেছে ঢাকাসহ সারা দেশ। ভিজে গিয়েছিল বইমেলা, নাগরিক জীবন, নান্দনিক বিন্যাস। প্রকৃতিতে তাণ্ডবতার প্রচ্ছন্ন ছাপ ফেলে ঝরে গেছে নব-অঙ্কুরিত আমের মুকুল, কচি শাখা, সতেজ পত্রালী।
এটা ঠিক যে, প্রকৃতি ও পরিবেশের আবহমানতায় বাংলাদেশে চৈত্র মাস রুদ্র বৈভব নিয়ে আসে। রূপ-রঙ-সৌরভের স্মৃতিময় ফাল্গুনকে বিদায় জানিয়ে তাপ ও দহনের গতিবেগে আসে চৈত্র। চৈত্র জানান দেয়, কালবৈশাখীর আগাম বার্তা। দিগন্ত ছেয়ে কালো মেঘের আনাগোনায় ঘোষণা করে নতুন বছরের নতুন মাস বৈশাখের পদধ্বনি। চৈত্রের দাপটে ক্রমেই শেষ হয় মৃদুমন্দ উদাসী হাওয়ার মখমল পেলব বাসন্তী দিন, স্বপ্নমেদুর রাত্রি আর রঙিন উৎসবময়তার চালচিত্র।
দিন আর রাত্রে দামাল বাতাসের ছন্নছাড়া প্রতাপে চৈত্র অস্থির করে যাপিত জীবন। তপ্ত ও নিঃসঙ্গ দুপুরের ক্যানভাসে খা খা করে চরাচর। ফেটে চৌচির হয় ভূমিতল। হঠাৎ ঝড়ো-বৃষ্টির ছোঁয়ায় কিছুটা জলমগ্ন হলেও নিজের রুক্ষতাকে মোটেও আড়াল করে না চৈত্র। মধ্যাহ্নের একেলা পাখিটিও স্তব্ধ হয়ে ভুলে যায় সুরেলা কূজন। চারিদিকের গুমোট পরিবেশে না বলে চলে আসা ঝড়ের হাতছানিতে মনে পড়ে ভয়ঙ্কর সুন্দরকে। হলদে ধূসর শূন্যতার মাঝে কাটে চৈত্র-তাপিত বিষণ্ন জীবন। তাপদগ্ধ পাণ্ডুর অবয়বে চৈত্র টেনে নেয় প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবনকে; জীবনের যাবতীয় সবুজ ও সৌরভ।
চৈত্র যেন শুষে নিতে চায় জলমগ্ন জীবনের সজল সুষমা। খাল, বিল, নদী, নালা আসন্ন বর্ষায় ভরপুর হওয়ার আগে নিঃশেষ হয় চৈত্রের দহনে। কখনো তীব্র খরার করাল গ্রাসে গ্রামবাংলার সামান্য সবুজ আর শ্যামলকেও রেহাই দিতে চায় না। ঘর্মাক্ত শরীরে মানুষ এবং দূরতম নীলিমার হাহাকার-চিল তাকিয়ে দেখে প্রকৃতির সর্বনাশা তাণ্ডব।
রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ -এ উল্লেখিত যে বিখ্যাত উক্তি শুরুতে দেওয়া হয়েছে, কে জানে, ভরাচৈত্রে প্রেয়সীর চোখে কোন সর্বনাশের ছবি দেখে প্রিয়তম পুরুষ? হয়ত বলে, চৈত্রও ভালোবাসাকে রিক্ত হতে দেয় না। চৈত্রের দাবদাহ ও তাণ্ডবতাতেও যেমন প্রকৃতিতে লাল-আগুন জ্বেলে পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া জেগে থাকে, তেমনি জেগে থাকে অমরাবতীর পথ, ভালোবাসার সরণী। স্বচ্ছ জ্যোৎস্না, তারায় ভরা আকাশ আর সেই আকাশের নক্ষত্রখচিত আয়না ও আঁখিতারায় তো শুধু সর্বনাশই লিপিবদ্ধ হয়নি। রচিত হয় ভালোবাসার গুচ্ছগুচ্ছ বর্ণালী।
রুক্ষ চৈত্র সব কেড়ে নিলেও ঝরা পাতাদের উল্লাসে ধরে রাখে বসন্তের কিছু কিছু স্মৃতি আর প্রেমের আকুতি। চৈত্র জাগ্রত রাখে ভালোবাসার প্রতীতি। সে ভালোবাসায় ‘সর্বনাশ’ লেখা থাকলেও তা মুছে দেয় মানব-মানবীর অন্তর্গত বেদনার নদী। হৃদয়ের গহীন-গভীরে কে কাঁদে প্রেমে ও ভালোবেসে, চৈত্র শুধু মানবীয় রহস্যের সে কথাটি জানে!
আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের সর্বনাশগুলোকে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও ঐক্যের চৈতালী বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার কথাও ভাবতে হবে এই প্রখর চৈত্রদিনে। তাণ্ডবের বিপরীতে তবু আনতে হবে জীবনের আবাহন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম।