চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া মনে করেন, ‘ফরিদপুর জেলার জনজীবন নদী, কৃষি ও কৃষিপণ্য দ্বারা প্রভাবিত। জনসংখ্যার অধিকাংশই কৃষির প্রতি নির্ভরশীল হওয়ায় জেলায় নগরায়ণের হার শ্লথ। শিল্পায়নও তেমনভাবে হয়নি।’
বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা: প্রসঙ্গ স্থানীয় ইতিহাস চর্চা’ শীর্ষক এক গবেষণায় ড. কিবরিয়া আরও মন্তব্য করেন যে ‘স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় সাধারণ জনজীবনের যে প্রতিফলন থাকা প্রয়োজন, তা অদ্যাবধি দেখা যায় নি। বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে সমকালীন প্রামাণ্য ইতিহাস লেখার সুযোগ রয়েছে, যাতে অতীতের পাশাপাশি বর্তমানের সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরা সম্ভব হবে।’
গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রাচীণ বঙ্গের অংশ ফরিদপুর অঞ্চল বলতে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বের গতিপথ এবং ভাগীরথী নদীর মধ্যবর্তী পদ্মা নদীর দক্ষিণাংশে অবস্থিত বিশাল এলাকাকে বোঝায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (৩৮০-৪১২ খ্রিস্টাব্দ) আমলে মহাকবি কালিদাস রচিত ‘রঘুবংশ’ কাব্যে ফরিদপুর অঞ্চল সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে যে ‘অধিবাসীরা নৌকা ও নদী বিষয়ক জ্ঞানে অভিজ্ঞ’।
পরবর্তী গুপ্ত যুগেও ফরিদপুর অঞ্চলের কথা ইতিহাসে উজ্জ্বলভাবে পাওয়া যায়। সে সময় গঙ্গা ও অন্যান্য নদী প্রবাহের গতিধারার কারণে ফরিদপুর অঞ্চলটি আরও দক্ষিণে বিস্তৃত হয়। এখানে মুদ্রা ও তাম্রশাসন পাওয়া যায়।
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর সমগ্র বাংলাদেশের মতো ফরিদপুর অঞ্চলও তুর্কি-মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। মুসলিম শাসনের অন্যতম পুরোধা হোসেন শাহ ফরিদপুরে (তখন নাম ছিল ফতাপুর) সর্বপ্রথম তার মুদ্রা প্রচলন করেন। সে সময় বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের বেশ কিছু পরগনার নাম হোসেন শাহের ভাই ও পুত্রদের নামে রাখা হয়।
প্রাচীন ফতাবাদ ও বর্তমান ফরিদপুরকে অনেক ঐতিহাসিক অভিন্ন বলে মনে করেছেন। ফতাবাদ নামটি বাংলার শাসক জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের নাম থেকে উৎসারিত বলে ধারণা করা হয়। তবে সরকারি কাগজপত্রে ফরিদপুর নামটি নবীন, তা ব্রিটিশ আমল থেকে পাওয়া যায়। ১৮৫০ সালে ফরিদপুর জেলার নামকরণ করা হয়। বিখ্যাত কামেল দরবেশ শেখ ফরিদউদ্দিনের নামানুসারে জেলার নামকরণ করা হয়। তিনি একজন বিখ্যাত সুফি ও পরিব্রাজক ছিলেন। বাবা ফরিদ শকরগঞ্জ শেখ ফরিদের অন্য নাম ছিল। ফরিদপুর শহরে যে সমাধি রয়েছে, সেটি তার নয় বলে অনেকের অভিমত। কারণ হযরত শেখ ফরিদের মাজার রয়েছে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের পাকপত্তন এলাকায়। যিনি দাতা গঞ্জেশকর নামে সমধিক পরিচিত এবং ১২৬৫ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফরিদপুরের ভৌগোলিক ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ এবং পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর ঢাকা-বিক্রমপুর, বরিশাল-খুলনা-যশোর এবং পাবনা-রাজশাহীর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অনেক সময় পাশের এলাকার অংশ বিশেষ ফরিদপুরের অন্তর্গত হয়েছে। আবার কখনও ফরিদপুরের কিছু কিছু এলাকা পাশের জেলার সঙ্গে একীভূত হয়েছে। মূলত নদীর বাঁক বদল ও যাতায়াতের দিক বিবেচনা করে প্রশাসনিকভাবে এমন পরিবর্তন হয়েছে।
ইতিহাস ও ভূগোলের পাশাপাশি সমাজতত্ত্বের বর্ণিলতায় ফরিদপুর বহুমাত্রিক মানব সমাজের প্রাচীন বসতি রূপে পরিগণিত। আর্য ও মুসলিম যুগের জাতিগত বৈচিত্র্যের ঐতিহ্য ফরিদপুরের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমলেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯১৬ সালে জরিপে দেখা যায়, জেলার ৬৩ ভাগ মানুষ মুসলিম ও কৃষিজীবী আর বাকীরা হিন্দু ও মৎস্যজীবী। তবে, উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো- এশিয়ার বাইরে থেকে আগত বেশ কিছু জাতি স্থায়ীভাবে ফরিদপুর অঞ্চলে বসবাস করতেন।
‘অ্যা স্ট্যাটিস্টিক্যাল একাউন্ট অব বেঙ্গল’-এ উইলিয়াম হান্টার জানাচ্ছেন যে ফরিদপুরে ৪২ জন ইংরেজ, একজন ফরাসি, একজন জার্মান, ১২ জন আইরিশ, দুইজন পার্শি, দুইজন স্কটিশ, তিনজন ওয়েলশবাসী এবং দুইজন আমেরিকান বসবাস করেন। তারা ব্যবসা ও বিভিন্ন পেশায় জড়িত হলেও সামাজিকভাবে স্থিত ও স্থায়ী বসতি গড়েছেন।
ফরিদপুরের দক্ষিণে ‘চণ্ডাল’ -এর সংখ্যা বেশি ছিল, ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ -এ যাদেরকে কৈবর্ত্য শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। ফরিদপুরে খ্রিস্টান ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের লোকদের একটি বড় অংশ বসবাস করতেন বলেও ইতিহাসে উল্লেখিত হয়েছে।
উপমহাদেশের বেশ কিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের জন্য ফরিদপুর বিখ্যাত। উপনিবেশ বিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলন এবং কৃষক-প্রজার অধিকার আদায়ের সংগ্রামী ঐতিহ্য মিশে আছে বৃহত্তর ফরিদপুরের নদী সিকস্তি বিস্তৃর্ণ জনপথে। জনজীবনে মিশে আছে চিরায়ত নদীমাতৃক বাঙালি সংস্কৃতির পরম্পরা।