ললাটে জঙ্গিবাদের অমোচনীয় তকমা

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 10:11:34

 

পাকিস্তানে শিয়া ও সুন্নি লড়াই থেমে থেমে চলছে তিন দশক ধরে। নানা সময়ে সংঘাতের কম-বৃদ্ধি হলেও সমস্যাটি প্রশমিত হয়নি। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব-সংঘাত-লড়াই পাকিস্তানের ক্রনিক সমস্যা এবং দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ক্ষতিকর সঙ্কট রূপে চিহ্নিত।

সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পরিসংখ্যানে জানা যায়, সংঘাতে এ পর্যন্ত শিয়াদের পাঁচ হাজার সদস্য মারা গেছেন এবং ১০ হাজার জন আহত হয়েছেন। সুন্নিদের ক্ষেত্রেও হতাহতের সংখ্যা কমবেশি একই।

১৯৮৯ সাল থেকে রক্ষিত পরিসংখ্যানে এ পর্যন্ত ১০ থেকে ১৫ হাজার শিয়া ও সুন্নি সদস্যের জানমালে ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়। গ্রাম ও শহরে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সমান।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্রতিটি আক্রমণেরই তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিআক্রমণ হয়েছে। বিষয়টি চলছে আদিম যুগের ‘খুনের বদলা খুন’ নামক বর্বর ও নৃশংস নীতিতে।

আরও পড়ুন: জন্ম থেকে সংঘাতের চারণভূমি

কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, পাকিস্তানে বছরে কমপক্ষে একহাজার মানুষ শিয়া-সুন্নি লড়াইয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। আহত হচ্ছে কয়েক সহস্র। আরেকটি মারাত্মক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের ফলে। তা হলো গুম। উভয় পক্ষে কতজনকে যে গুম করা হয়েছে বা অপহরণ করা হয়েছে, তার ইয়াত্তা নেই।

প্রতিটি গুম ও অপহরণের শেষ ফলাফল হত্যাকাণ্ড বলে মনে করা হয়। সাধারণ ধারণা হলো, পাকিস্তানে গুম ও অপহরণ মানেই গোপন হত্যাকাণ্ড, যে হত্যার কোনও রেকর্ড ও প্রমাণ থাকে না। এমনকি, লাশটিও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।

এতো পুরনো, রক্তাক্ত ও ক্ষতিকর সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যাটির প্রবল রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত গুরুত্ব থাকলেও তা প্রশমনে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা নেই। বরং উভয় গ্রুপেরই ধর্মীয়-রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ও প্রচার-প্রচারণার কারণে প্রতিশোধমূলক মনোবৃত্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

প্রতিটি সংঘাতের ঘটনার পর নতুন করে হিংসা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করা হচ্ছে। প্রতিটি আঘাতেরই তীব্র প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রত্যাঘাত করা হচ্ছে। একজনের বদলে এক তো বটেই, কখনো কখনো প্রতিশোধমূলক হামলার মাধ্যমে ১০ জনকেও মেরে ফেলা হচ্ছে। বিশেষত শিয়াদের মহররম মাসের তাজিয়া অনুষ্ঠানে ও ইমামবাড়ার সমাবেশে বোমা-অস্ত্রসহ নৃশংস হামলা চালানো হচ্ছে। পক্ষান্তরে সুন্নিদের শুক্রবারের জুমার নামাজেও বড় আকারের সশস্ত্র হামলা করা হচ্ছে। উভয় ক্ষেত্রেই উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষগুলো অকাতরে মারা যাচ্ছেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো পাকিস্তানে শিয়া-সুন্নি হামলায় অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বোমা ব্যবহারের পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন উভয় পক্ষের সুইসাইড স্কোয়াডের আত্মঘাতী সদস্যরা। উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় নেতাদেরও নিহতের তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে। মসজিদ ও ধর্মস্থানে সাধারণ গণহত্যার সঙ্গে সঙ্গে বাসা-বাড়িতেও পরিকল্পিত টার্গেট ভিত্তিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বিশিষ্ট শিয়া ও সুন্নি নেতারা।

সংঘাতে বিপর্যস্ত পাকিস্তান, ছবি: সংগৃহীত

 

পাকিস্তানের অনেক শহরেই শিয়া ও সুন্নি মতের অনুসারী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে চলেন। তারপরেও কোনও পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই যখন তখন উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ লেগে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে প্রায়শই। বিশেষত হিংসার আগুনে দগ্ধ প্রাচীন ও ঐতিহাসিক শহর করাচির অবস্থা অতি শোচনীয়। প্রায়শই করাচিকে তুলনা করা হচ্ছে সংঘাতের নগর বৈরুতের সঙ্গে।

আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যে ও গবেষণায় পাকিস্তানকে সেক্টেরিয়ান সংঘাত বা গোষ্ঠী/সম্প্রদায়গত সংঘাতের চারণভূমি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। মূলত ধর্মীয় সম্প্রদায়গত বিভাজন থেকে সংঘাতের সূচনা ও প্রসার হলেও এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে সামরিক ও বেসামরিক নেতারা সংঘাত জিইয়ে রেখে ফায়দা নিচ্ছেন।

সংঘাতের অর্থনৈতিক লাভের মধ্যে অস্ত্র বিক্রি ব্যাপক গুরুত্ব পাচ্ছে পাকিস্তানে। যে টাকার বখরা প্রশাসন, নেতারা পেয়ে থাকেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে পাকিস্তানে সাধারণ হাট-বাজারে অস্ত্র পাওয়া যাচ্ছে এবং যে কেউ চাইলে সর্বাধুনিক-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র কিনতে পারছেন।

পাকিস্তানের সাধারণ জনজীবন, পর্যটন ও ভ্রমণ বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের কারণে। চরম ভীতি ও আতঙ্কে মানুষ জীবন-যাপন করছেন সেখানে। কখন, কোথায় লড়াই লেগে কার জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে, তা কারো জানা নেই।

আরও পড়ুন: চলছে ‘খুনের বদলা খুন’!

সমাজে শিয়া ও সুন্নিরা বসবাস করছেন পারস্পরিক হিংসা ও ঘৃণা নিয়ে এবং একে অপরকে আক্রমণের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব লালন করেন। গবেষকরা ‘এক নিঃশব্দ গৃহযুদ্ধ’ নামে অভিহিত করছেন পাকিস্তানের শিয়া-সুন্নিদের মধ্যকার সংঘাতময় পরিস্থিতিকে, যাকে দেশটির সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার হুমকি বলেও মনে করা হচ্ছে।

পরিতাপের বিষয় হলো হিংসা ও উগ্রতা ছড়িয়ে পাকিস্তানের নেতারা বছরের পর বছর ধরে একে অপরের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত করছেন। সাধারণ জনজীবনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যাহত করছেন। ফল স্বরূপ পাকিস্তান পরিণত হয়েছে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের এক বিপন্ন জনপদে, সংঘাতের রক্তাক্ত দুষ্টচক্র থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছেন না এবং বেরও হতে পারছেন না।

আরও পরিতাপের বিষয় এটাই যে একই ধর্মের মধ্যকার দুই বিবদমান সম্প্রদায়কে থামানোর মতো কোনও সর্বজনমান্য ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতার দেখা পাকিস্তানে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই কোনও না কোনও গ্রুপ বা গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থেকে অপরাপর গ্রুপের সঙ্গে মতাদর্শিক বা সশস্ত্র লড়াই চালিয়েই যাচ্ছেন। পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন নিজ নিজ গ্রুপ বা মতের বিভিন্ন উগ্র ও জঙ্গি সংগঠনকে।

যার ফলে দেশটিতে ভীতি, নিরাপত্তাহীনতা, হানাহানি, রক্তপাত ও হতাহত বাড়ছেই। আর এভাবেই পাকিস্তান নামক দেশটির ললাটে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের অমোচনীয় তকমা লেগে গেছে। গবেষকদের মতে, ‘পাকিস্তান হয়ে উঠেছে উগ্রবাদ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও প্রজনন ক্ষেত্র’ এবং 'সংঘাতের ধর্মীয়-রাজনৈতিক রণক্ষেত্র', যা দেশটির 'অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ভঙ্গুর', 'অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত' এবং 'সামাজিক নাগরিক স্থিতিশীলতাকে নাজুক' করে ফেলেছে।
(তৃতীয় কিস্তি)

এ সম্পর্কিত আরও খবর