অবশেষে বুধবার (৫ জুন) দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (৪ জুন) মধ্যপ্রাচ্যের আরব জাহানে ঈদ পালিত হয়েছে। বুধবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চাঁদ দেখা ও ঈদ পালনের ঘোষণার বেশ পরে (রাত ১১ টা ২২ মিনিট) বাংলাদেশের ঈদের ঘোষণা আসে। সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারের মতো তীব্রতায় ঘোষিত হয় ‘ঈদ মোবারক’।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বিলম্বিত বা দ্বিধাগ্রস্ত ঘোষণায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের দ্বিধান্বিত ও বিলম্বিত ঘোষণার কবল থেকে সংশ্লিষ্টরা মুক্ত থাকবেন বলেই সবাই আশা করেন।
এক মাস কঠোর কৃচ্ছ্বতা ও রোজা পালনের পর যে ঈদ আসে, তাতে তৃপ্তি ও উৎসবের বার্তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও আনন্দের আবাহন। নাড়ির টানে মানুষ ছুটে যান বাড়িতে, প্রিয় সান্নিধ্যে। প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ উপলক্ষ্যে কমপক্ষে আড়াই কোটি মানুষ যাতায়াত করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। ঢাকা ছেড়েছেন দেড় কোটি মানুষ।
যানজট ও পথের বিভ্রাট ইত্যাদি অগ্রাহ্য করে সবাই নিরাপদে ঈদযাত্রা সম্পন্ন করতে পেরেছেন। ট্রেনে, বাসে ভিড় ও সিডিউল বিপর্যয়ের পরেও মানুষের অম্লান আনন্দ ম্লান হয়নি। চিত্তানন্দে সবাই ঈদ উদযাপনের অনাবিল আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন।
ঈদ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির আনন্দ ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের রেশ ধরে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির আবহ সৃষ্টি হয় সমাজের সর্বস্তরে। ধনী, দরিদ্র, উচ্চ, নিম্ন সবাই সাধ্য মতো পরিবার-পরিজন নিয়ে শরিক হন ঈদের আনন্দ ও আনুষ্ঠানিকতায়।
সামাজিক অঙ্গনে ঈদের পরশে ইতিবাচকতার সঞ্চার হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপযপূর্ণ। আমাদের জীবনে আত্মীয়-পরিজনের মধ্যে মেলামেশার মাধ্যমে সৃষ্ট এই সামাজিক গতিশীলতার মূল্য অপরিসীম। আমরা আমাদের পরিচিতি ও শেকড়ের স্পর্শ অনুভব করি সর্বজনীন উৎসবের মাধ্যমে।
এবারের ঈদে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্থা দুস্থ ও অসহায়দের মধ্যে ঈদ সামগ্রী, উপহার ও পোষাক বিতরণ করেছে। যাকাতের কাপড় বিতরণের নামে অতীতের মতো এবার পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যুর খবর আসে নি। দিনে দিনে মানুষের মধ্যে সামাজিক ও মানবিক সচেতনা বৃদ্ধির এ ধারা আশাপ্রদ।
রমজানের রোজার শিক্ষায় আমরা যেমন ত্যাগ, কৃচ্ছ্বতা, আত্মসংযমের দীক্ষা লাভ করি, ঈদেও আমরা পাই মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বশীলতার প্রেরণা। সকলের সঙ্গে সকলের শুভেচ্ছা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বিনিময়ের যে ধারা ঈদের উৎসবের বাতাবরণে উপস্থিত হয়, তাতে ব্যক্তির আনন্দ বহু গুণে বৃদ্ধি পায় এবং ব্যক্তিগত আনন্দের অংশভাগ সামাজিক আনন্দের বিশালতায় রূপান্তরিত হয়।
এমনিতেই বাংলাদেশের সমাজ জীবনে অনেক কঠোরতা, স্বার্থপরতা ও নিম্নমানের আচরণ বিকশিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে মানবিক মূল্যবোধের বদলে নৃশংসতারও দেখা পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের কল্যাণ চিন্তার বদলে কতিপয় ব্যক্তি বর্বরের মতো ঘুষ, দুর্নীতি, ভেজাল, মূ্ল্যবৃদ্ধিতে লিপ্ত হচ্ছে। খুন, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো পাশবিকতাকে প্রদর্শন করছেন কোনও কোনও মানুষ।
এমনই বিরূপতার মধ্যে রমজানের কৃচ্ছ্বতার শেষে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও আনন্দের বার্তাবাহী ঈদ আমাদেরকে আত্ম-উপলব্ধির সুযোগ দিচ্ছে। মানুষ হিসেবে মানবিক ও সামাজিক দায়িত্বের বিষয়গুলো অনুধাবণের প্রণোদনা দিচ্ছে। নিজের পাশবিক সত্ত্বাকে বিসর্জন নিয়ে মানবিক-সামাজিক আলোকদীপ্তিতে উদ্ভাসিত হওয়ার প্রতীতি জাগাচ্ছে।
ফলে ঈদের উৎসবে ব্যক্তিগত আনন্দ ও উপভোগের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির বদলে যতটুকু সম্ভব মানবিক ও সামাজিক হওয়াই বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সকলের কর্তব্য। পরিবারের ও সমাজের প্রপীড়িত, দুস্থ, পশ্চাৎপদ, অবহেলিত মানুষের মর্ম যাতনাকেও হৃদয়ঙ্গম করা সকলের দায়িত্ব। কারণ, উৎসব ও আনন্দ তখনই সার্থক ও সফল হয়, যখন তা সবার মুখে হাসি আনতে পারে।
কেবলমাত্র নিজের একচ্ছত্র ভোগ ও আনন্দ কোনও কাজের কাজ নয়। সবাইকে নিয়ে আনন্দিত ও সুখী হতে পারার মধ্যেই রয়েছে মহত্ত্ব। সকলের মধ্যে ভীতি, আতঙ্ক, হতাশার ছাপ মুছে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও আনন্দের অবারিত ফল্গুধারা সঞ্চারিত করার চেয়ে মহৎ আর কিছুতেই হতে পারে না।
ঈদ আমাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মহত্তম উৎসবের মাধ্যমে স্বর্ণালোকিত আয়োজনে উদ্ভাসিত হোক। ব্যক্তির আনন্দকে সমাজে প্রসারিত করুক। পবিত্র অনুষ্ঠানের নানা আয়োজনে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও আনন্দের বার্তাকে বছরের বাকি দিনগুলোকেও আলোকোজ্জ্বল আভায় ভরিয়ে তুলুক।