মেঘপাহাড়ের ডাক অনেকদিনের। ঈদের ছুটিতে ফুরসত হবে বলে পরিকল্পনা ছিল মেঘের বাড়ি মেঘালয়ে যাব। শিলংবাসী কলকাতার কবি ফাল্গুণী চক্রবর্তী কয়েকবছর আগে নিমন্ত্রণ দিয়ে রেখেছেন। এই পরিকল্পনা পোক্ত করে দিলেন খাসি ভাষার অন্যতম প্রধান কবি ও শিক্ষাবিদ মিসেস স্ট্রিমলেট ডেখার। দুই লেখক সবান্ধব ঢাকা এলেন রোজার দু’মাস আগে। দলে খাসি ভাষার লেখক মিস বাখিয়া মন, শিল্পী ইভানিশা পাথাও। নিমন্ত্রণ দিলেন। ঢাকার আতিথেয়তায় মুগ্ধ স্ট্রিমলেট বললেন, তোমরা নেহু’র অতিথি হিসাবে আমাদের গেস্ট হাউজেই থাকতে পারো। পাহাড়ের ওপরে চমৎকার গেস্ট হাউজ, দৃষ্টিনন্দন, কাম এ্যান্ড কোয়াইট। এই লোভনীয় অফারে ঘি ঢাললো, লেখক দলের কনিষ্ঠা সদস্য ইভানিশা, শিলং ইজ টাইনি সিটি, বাট ভেরি নাইস।
নেহু-নর্থ ইস্টার্ণ হিল ইউনিভার্সিটি। এ কথা আগে শুনেছিলাম কবি ফাল্গুণী চক্রবর্তীর কাছে। ফাল্গুণীর ফেসবুক প্রোফাইলে নেহু’তে পড়াশুনার তথ্যটি আছে। কলকাতায় জন্ম নেয়া ফাল্গুণী দীর্ঘদিন শিলংবাসী। লেখাপড়াও করেছেন সেখানে। নিখিলবঙ্গ ভারতে যতো কবি-লেখক সম্মেলন হয়, ফাল্গুণী নিমন্ত্রণ পান বাঙালি কবি হিসাবে, তাঁকে প্রোজেক্ট করা হয় মেঘালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে। সম্মেলনে হাত উঁচু করার ঘোষণায় বিভিন্ন দেশ ও রাজ্যের বিপরীতে অসংখ্য হাত উঠলেও মেঘালয় নামের সঙ্গে একটি হাতই ওঠে, ফাল্গুণীর হাত। এই বিশেষত্ব লেখালেখির জগতে ফাল্গুণীকে বেশ পরিচিতি দিয়েছে। স্ট্রিমলেট ডেখার নেহু’র মানববিদ্যা ফ্যাকাল্টির ডীন। খাসি জাতিসত্তার লেখক ও শিক্ষাবিদ হিসাবে মেঘালয়ের বিদ্বজ্জন সমাজে তাঁর পরিচিতি ও সম্মান ওপরের দিকেই।
এমন দু’জন সজ্জন মানুষের ডাক আর নিজের ভ্রমণ-বোহেমিয়ানা স্বভাবের ভেতর লুকিয়ে থাকা মেঘপাহাড়ের ডাকে এই ভ্রমণ-যাত্রায় আমি রীতিমতো উজ্জীবিত। পঞ্চাশোর্ধ জীবনের অন্তত তিনদশক জুড়ে বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে ছুটে চলেছি, কিন্তু মেঘের বাড়ি মেঘালয় ভ্রমণযাত্রার মতো এতোটা আগ্রহ-আকুল আর কোন ভ্রমণে হইনি। এই উজ্জীবনের অন্যতম কারণ হতে পারে হোস্টগণ ভিনদেশি, ভিন জাতিসত্তার। নয়ন জুড়ানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিভ্রমণের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ভ্রমণের অনিবার্য অনুষঙ্গ। আর এই মিথস্ক্রিয়া যদি হয় ভিন্ন একটি দেশ, ভাষা ও জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! এক্সাইটমেন্টের জন্য ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যুক্ত করি গৃহবন্ধু জুলেখা ফেরদৌসী, আত্মার আত্মীয় তুসু মাহমুদকে। মেঘপাহাড়ের ডাক শুনে ট্রিপে যুক্ত হতে আমন্ত্রণ জানাই লেখকবন্ধু ভ্রামণিক কামরুল হাসানকে। সবে মিলে চারজনের ভ্রমণযাত্রা।
শুরু হলো প্রস্তুতি। মেঘালয় যেতে সহজ সীমান্ত তামাবিল-ডাউকি। সিলেট শহর থেকে দুই সোয়া দুই ঘণ্টার ড্রাইভ তামাবিল। একমাস আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে নোহা মাইক্রো আর দক্ষ চালক দীপককে। সীমান্ত পেরিয়ে ডাউকি। উমগট নদী পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় আড়াই-তিনঘন্টার পথ শিলং। তামাবিল-ডাউকি অতিক্রম করতে হলে ভিসায় সীমান্তের নাম উল্লেখ থাকতে হবে। আমাদের ভিসায় আগে থেকেই বন্দর হিসাবে ডাউকি উল্লেখ ছিল। ভ্রামণিক কামরুল হাসানের পাসপোর্ট সীমান্ত বদলের জন্য জমা দেয়া হলো হাইকমিশনে। ঠিক হলো ঈদের উৎসবের পর ছুটির সদগতি করা হবে। মেঘপাহাড়ের ডাকে ছুট দিতে হবে। ৫ বা ৬ জুনে ঈদ যেদিনই হোক, আমাদের যাত্রা হবে ৭জুন ।
কি সর্বনাশ, সীমান্ত পর্যন্ত যাবো কি করে ? ঈদ সমাগত, লাখো মানুষ এ সময় রাজধানী ছেড়ে পাড়ি জমায় আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে। ট্রেন, বাস, বিমানের আগাম টিকেট প্রায় শেষ! আমাদের প্রথম পছন্দ ট্রেনের আশা ছেড়ে দিতে হলো। বাসের টিকেটেরও হদিশ করা গেল না। আমরা নাছোড়, বাজেট বাড়িয়ে বিমানে বুকিংয়ের চেষ্টা করতেই সফল। ছয় হাজারের বাজেট ঠেকলো চব্বিশে। ঈদ উৎসবের সময় বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে তামাবিল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ি খোজাখুজি বেমানান। তাই রিজার্ভ করা হলো মাইক্রোবাস। শিলংয়ের নেহু গেস্ট হাউজ শহরকেন্দ্র করে থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে। ভ্রমণদলের কারও কারও পছন্দ সিটি সেন্টারের শপিং মল। পুরো ভ্রমণে শহরের ফ্লেভার পেতে একরাতের জন্য দৃষ্টিনন্দন হোটেলও বুকিং দেয়া হলো। এমন একটি হোটেল যার জানালা দিয়ে দূরে আর পাহাড় মিতালী করে থাকে। যাকে বলে মেঘপাহাড়ের হাতছানি!
এদিকে হোস্ট লেখকবৃন্দ উৎসাহ-উদ্দীপনার দিক থেকে আরও এককাঠি সরেষ। ‘ভ্রমণগদ্যশিলংট্রিপ’ নামে তারা হোয়াটসআপে গ্রুপ খুলে আমাদের আগ্রহ-আকুল ভ্রমণযাত্রার এক্সাইটমেন্ট বহুগুণে বাড়িয়ে দিলেন। মেজবান-মেহমান উভয়পক্ষই এক্সাইটেড । যুক্ত করা হলো আমেরিকাবাসী আমাদের পরিবারের জৈষ্ঠ্য সদস্যকে। গ্রুপে আদান-প্রদান হতে থাকলো ভ্রমণ-অগ্রগতির নানাদিক। জানা গেল, মেজবানপক্ষ মেহমানদের মেঘরাজ্যে স্বাগত জানাত মেঘপাহাড় ডিঙিয়ে সীমান্তে ছুটে আসবেন। উভয়পক্ষের আগ্রহ-উত্তেজনা টান টান। ভ্রমণফিরিস্তি, মেঘকন্যা মেঘালয়ের আবহাওয়া, বৃষ্টি-মেঘের তথ্য, ভ্রামণিকের পোশাক পরিচ্ছদ, ভ্রমণটুলস সম্পর্কিত ছবি, ভিডিও, তথ্য পোস্ট হতে থাকলো। বাংলাদেশে বর্ষা সমাগত হলেও ভ্রমণের সময় মেঘের রাজ্যে ভরবর্ষা। এরওপর ভ্রমণনির্ঘন্টে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে আতিবৃষ্টির বিশ্বরাজধানী চেরাপুঞ্জি। গ্রুপে পরামর্শ আসলো বৃষ্টি আবাহনের পোশাক আর টুলসকে করতে হবে ভ্রমণসঙ্গী। ভরবর্ষায় মেঘের রাজ্যে বৃষ্টির বিশ্বরাজধানীতে যাবো, ভিজবো না, তা কি করে হয়! জনে জনে কেনা হলো ছাতা। কিনলাম রেইনকোট। বাসায় কাপড়চোপড়ের ওপর রেইনকোট চাপিয়ে ফ্যাশন শো হলো। সেই ছবি গেল গ্রুপে। লাইকের পর লাইক।
সব তো হলো, ‘হোয়াট এ্যাবাউট সু’?
গ্রুপে প্রশ্ন করতেই পরামর্শ এলো মেঘরাজ্যের দর্শনীয় পাহাড়ি ঝর্ণা, শিলং পিক বা শিলংশীর্ষ, উমিয়াম লেক ইত্যাদি পাহাড়-পর্ব্বতময়। চোখ জুড়াতে দ্রষ্টব্যের নিকটে যেতে গাড়ি থেকে নেমে ওপর-নিচে ওঠানামা করতে হয়। নিতে হবে এমন জুতো যা বৃষ্টি সহনক্ষম, গ্রিপযুক্ত। গৃহবন্ধু জলি সনাতনধারার কামিজ-পায়জামা পরবে বলে কেডসবেমানান, সে অভ্যস্থও না। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে গ্রিপওলা স্যান্ডেল কিনলো। আমি ঈদ বাজারের উপচানো ভিঁড়ের মধ্যে খোজাখুজি শুরু করলাম। কি? পাঞ্জাবী না। গ্রিপওলা কেডস। শেষমেষ কেনা হলো চায়নিজ নাইকি। এতোসব আয়োজনে একটা স্পঞ্জের চটি না হলে চলবে কেন? তবে কোথায় সে চটি ? বাটা, এ্যাপেক্স, লোটো, জেনিস- জুতোর ব্রান্ডগুলো এখন আর স্পঞ্জ বাণিজ্যে মনোনিবেশ করে না। ছোটবেলায় সানডাক টানডাক নামের কতোরকমের স্পঞ্জ চটি-স্যান্ডেল দেখেছি, এখন তা গোটা বাজার থেকেই তা উধাও। পরিশেষে চায়নিজ চটি খুজে পেলাম গুলিস্তানের ফুটপাতে। এক বৃষ্টির দিনে এগুলো পড়ে একদফা মহড়া করতেও পিছপা হলাম না।
ভ্রমণ-নির্ঘণ্টে দিনওয়াইজ নানা ট্যুরিস্ট স্পটের নাম। ডে টু ফর সিটি এট্রাকশন্স। উমিয়াম লেক, ডন বস্কো মিউজিয়াম, শিলং ভিউপয়েন্ট, ওয়ার্ডস লেক, শিলং পিক, গ্র্যান্ড মদীনা মসজিদ, খাসি হেরিটেজ ভিলেজ, রবীন্দ্র স্মৃতিবজড়িত ব্রুকসাইড বাংলো, জিতভুম বা সিধলি হাউজ ইত্যাদি। ভ্রমণসূচীটি পোস্ট হলো গ্রুপে। স্ট্রিমলেট ডেখার নির্ঘন্ট দেখে ওয়াও সিম্বল দিয়ে লিখলেন, মেঘালয়বাসী ছাড়া এই নির্ঘণ্ট তৈরি অসম্ভব। উৎফুল্ল হয়ে আমার জবাব: আই এ্যাম এ্যা গ্রেট ট্রাভেলার, আই গুগলড এ লট, সো ওয়েব ট্রিপ হাজ ডান অলরেডি। কথা সেটাই, জাহাজে চড়ে কয়েক মাস ধরে পবিত্র মক্কায় হজ্জ করতে যাওযার দিন শেষ। যে কোন জায়গার ওয়েব ট্যুর আজ বড় সহজ। আধুনিক প্রযুক্তি সবকিছু হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে।
জীবনের দিনগুলির বহুটা সময় আকাশে উড়ে গেছে। ভারতীয় মহাসাগরের পূর্বতিমুরের দিলি থেকে উড়েছি আলাস্কা সংলগ্ন সেন্ট জন নগরী পর্যন্ত। উড়েছি জাপান সাগর বা নরওয়েজিয়ান সমুদ্রের ওপর। বাড়ির কাছে আরশিনগর শৈলসুন্দরী শিলং ট্রিপের মতো এতোটা উদ্দীপ্ত হয়েছি কি না, এতোটা প্রস্তুতি নিয়েছি কি না মনে পড়ে না। এই যাত্রার চিত্রকল্প হচ্ছে, উড়ছি দেশের আকাশেই। হেঁটে অতিক্রম করছি সীমান্ত। হাতে ছাতা, গায়ে রেইনকোট, পায়ে গ্রিপওলা স্যান্ডেল, চোখে রোদচশমা, পিঠে ব্যাকপ্যাক- অদ্ভূত এক পরিব্রাজকের চেহারায় পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠছি। পরিব্রাজকদলকে তাড়িয়ে নিচ্ছে বৃষ্টি। ঝাপসা মেঘের ভেতর দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি মেঘের বাড়ি-মেঘালয়ে।