প্রতিষ্ঠাতা জব চার্নকের দূরদৃষ্টি আর ইংরেজদের অবদানের কারণে কলকাতার মধ্যে চিরকালই থেকে যাবে একখণ্ড ইউরোপ। তিনশ বছর পুরনো শহরের সেন্ট্রাল কলকাতায় পা রাখলেই তা টের পাওয়া যায়।
নতুন কলকাতা যতই প্রসারিত হোক, আদি কলকাতার রাজকীয় ছাপ থাকছে অমলিন। ট্রাম, গথিক স্থাপনা, কলোনিয়াল বিল্ডিং মনে করিয়ে দেয় কলকাতার শরীরে ইউরোপীয় ছোঁয়া।
শুধু ইংরেজ নয়, পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, ডাচ, ফরাসিদের চার্চ, ভবন, প্রাসাদ, কবরগাহ থেকে ভেসে আসে হারিয়ে যাওয়া ইউরোপীয়ানদের নস্টালজিক স্মৃতি। কানে আসে দূরাগত ট্রাম, চার্চের ঘণ্টাধ্বনি। পলেস্তারা-খসা হেরিটেজ দালানের দীর্ঘশ্বাস বয়ে যায় শরীর স্পর্শ করে।
কলকাতা শহর ইংরেজরা সাজিয়েছিল তাদের সমস্ত নিজস্বতা দিয়ে। বানাতে চেয়েছিল আরেক লন্ডন। তাদের হাত ধরে কলকাতায় ছায়া ফেলেছিল মধ্যযুগের লন্ডন। এসেছিল কেক পেস্ট্রির সুমিষ্ট ঘ্রাণ। কফিশপের তর্ক-আড্ডার পরিসর আর ধোঁয়াটে গন্ধ। হোটেলের বল ড্যান্সের লাগামহীন উল্লাস। ঘোড়দৌড় আর নানা সাহেবি কেতা।
কলকাতায় তৈরি হয়েছিল স্পেনসেস হোটেল, যা ছিল এশিয়ার প্রথম ইউরোপীয় স্টাইলের আবাসন। ১৮৩০ সালে হোটেলটি তৈরি করেন মিস্টার স্পেনস নামে এক ব্যক্তি। স্পেনসেস হোটেলকে তিনি বানিয়েছিলেন চোখ ধাঁধানো জৌলুসে। বলা হয়, ভারতবর্ষ তো বটেই, গোটা এশিয়া মহাদেশেই নাকি এই হোটেল ছিল প্রথম ‘হোটেল’।
ঔপনিবেশিক আমলে স্পেনসেসের খ্যাতি ছিল আকাশছোঁয়া। তার প্রমাণ মেলে জুলে ভার্নের লেখায়। 'The Steam House' বইতে তিনি উল্লেখ করছেন এই হোটেলটির কথা।
খোদ ইউরোপেও পৌঁছেছিল হোটেলের খ্যাতি। গভর্নমেন্ট হাউজের ঠিক উত্তরে ছিল প্রাচীনতম এই হোটেল। ১৮৪১ সালে এই হোটেলের অ্যাটাচড বাথরুমসহ একটি রুমের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। অবশ্য একমাসের জন্য। অতিথি সংখ্যা বাড়লে ২০ টাকা করে মাথাপিছু অতিরিক্ত চার্জ। সেই যুগে মহার্ঘ বললে কম বলা হয়।
কলকাতার প্রাণকেন্দ্র চৌরঙ্গীর চারপাশের অঞ্চলটি ছিল ইংরেজদের অতি প্রিয় জায়গা। সাধারণ ভাষায় 'হোয়াইট এরিয়া'। সেখানেই সার দিয়ে হোটেল, পানশালা, বিরাট বিরাট সব অট্টালিকা। পাশের লালবাজারে একদা ছিল লন্ডন ও হারমনিক পানশালা। ডেকার্স লেনে ছিল ম্যুরের পানশালা। আবার ছিল বেয়ার্ডের হোটেল। এইসবের আগেই স্পেনসেস হোটেল জমিয়েছিল তার আসর, যা এখনো ঔপনিবেশিক স্মৃতির মমি হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
কলকাতায় আরেকটি তাজমহল বানাতে চেয়েছিল ইংরেজরা। হয় নি। তাজমহল না হলেও হয়েছে আরেক মহার্ঘ স্থাপনা। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়েল। সবুজ ময়দানের বুকে একটি শ্বেতশুভ্র টিপ হয়ে আছে ইউরোপীয় অতীতের স্মৃতিবাহী ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়েল।
হগস সাহেবের নিউমার্কেট, ঘুরে বেড়ানোর এসপ্লানেট, উদ্যানের পাশের পার্ক স্ট্রিট, চিরায়ত গঙ্গা তীরের জেমস প্রিন্সেপ ঘাট, লন্ডন ব্রিজের স্মৃতিবাহী হাওড়া সেতু কলকাতার প্রধান ও আইকনিক দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ইউরোপীয় ইমেজের প্রতিচ্ছবি হয়ে সারাক্ষণ জেগে আছে তিলোত্তমা মহানগরীর শরীর জুড়ে।
উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানা আর দক্ষিণ কলকাতার আভিজাত্য ছাড়িয়ে পূর্ব কলকাতায় বিকাশমান হাইটেক-হাইরাইজ ল্যান্ডস্কেপ পেরিয়ে মধ্য কলকাতার স্মৃতিপটে একখণ্ড ইউরোপ চিরন্তনী আবেশে এখনো রয়েছে চির জাগ্রত।