রাজধানী ঢাকার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। এক সময়কার সুকাকু মহলের বড় দিঘি থেকে মতিঝিল বা মোতির দিঘি নামে পরিচিত ছিল এই এলাকা। যা পরবর্তীতে মতিঝিল নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই ঝিল বা দিঘির ঐতিহ্য এখনো রয়ে গেছে মতিঝিলে।
রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুর হয়ে মতিঝিল যাতায়াত করা কর্মজীবী মানুষের প্রধান পথ মতিঝিল গুদারাঘাট, যা কমলাপুর গুদারাঘাট নামেও পরিচিত। এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মানুষ পার হন। এর মধ্যে ১২০০ থেকে ১৩০০ মানুষ নিয়মিত যাতায়াত করেন এই ঘাট দিয়ে।
মানিকনগর, মুগদাপাড়া, গোপীবাগ, গোলাপবাগ ও দক্ষিণ কমলাপুরের শ্রমজীবী মানুষের মতিঝিল যাতায়াতের পছন্দের রাস্তা হল কমলাপুর গ্যারেজ পট্টি হয়ে সংক্ষিপ্ত পথে নৌকা পাড়ি দিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পৌঁছা। এতে সময়ও বাঁচে, সঙ্গে অর্থও। এই নৌকা পাড়ি দিতে লাগে দুই টাকা।
কমলাপুর গ্যারেজ পট্টি থেকে মতিঝিলের সুউচ্চ বাণিজ্যিক ভবনগুলো চোখে পড়ে। আর একেবারেই সন্নিকটে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন। রিকশায় বা গাড়িতে করে এই বাণিজ্যিক এলাকায় পৌঁছতে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হয়। সেই ঝামেলায় না গিয়ে দুই টাকায় নৌকা পাড়ি দিয়ে তিন থেকে চার মিনিটের মধ্যেই শাপলা চত্বর!
কমলাপুর বক্স কালভার্ট রোডের বাম পাশে এই গুদারাঘাট। ছোট গলি দিয়ে ঢুকতেই চোখে জীর্ণ একটি কাঠের বাক্স সামনে নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, প্রায় ২০ গজ দূরে পুকুরের পাড়। সামনে দিয়ে পার হতে গেলেই তার বিনয়ী ডাক, ‘ভাই, ভাড়া দিয়ে যান।’ নিয়মিত যাত্রীরা কোনো কথা বলার আগেই ভাড়া পরিশোধ করে ছুটছেন মতিঝিলগামী নৌকা ধরতে।
কাঠের বাক্স নিয়ে বসা বৃদ্ধা খেজু মিয়া। ঘাট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঐ ঘাট কি আর এখন আছে? ব্রিটিশ আমল থেকে জমজমাট ছিল এই ঘাট। পানিও ছিল আরও বেশি এবং স্বচ্ছ।’ একটু দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় তিনি বলেন, ‘এই যে শাপলা চত্বর দেখছেন, সেখান থেকে এক সময় মুগদা-মান্ডা পর্যন্ত নৌকা চলত। আর কোনো রাস্তাও ছিল না।’
খেজু মিয়া জানান, তার এই ৭০ বছরের জীবনের ৫০ বছরের উপরে কেটেছে এই ঘাট পরিচালনায়। তিনি একা নন, বর্তমানে আরও চার-পাঁচ জন তার মতো দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, ‘অফিস যেদিন খোলা থাকে, সেদিন তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া উঠে। ছুটির দিনে একটু কম উঠে।’
এই ঘাট দিয়ে দৈনিক কত লোক পার হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই টাকা করে ভাড়া, হিসেব করেন কত হয়। আর স্থানীয়রা অনেকেই তো ভাড়া দেন না। প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ লোকের ভাড়া পাই না। অনেক সময় খুচরার অভাবে দুই টাকা রাখা যায় না।’
আসা-যাওয়ার ভাড়া মিটিয়ে নৌকায় উঠে কথা হয় মাঝি মোখলেছ উদ্দিনের সঙ্গে। বয়স প্রায় ৬৫’র মতো। দেশ স্বাধীনের পর থেকেই তিনি এই ঘাটে আছেন বলে জানান। ঘাট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংগ্রামের পর থেকেই এই ঘাটে আছি। শুরুর দিকে যেমন ছিল, এখন আর তেমন নেই। যে টুকু আছে, তা কত দিন টিকে কে জানে।’
কদম ফুলের গাছে ঘেরা এই জলাশয়টুকুর নৌকায় পাড়ি দেওয়া অংশের দূরত্ব হবে আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ গজ। এরে একেবারে পাশেই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। এই ঝিলটুকু পাড়ি দিয়ে মিনিটখানেকের মধ্যেই শাপলা চত্বরে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মোখলেছ উদ্দিন জানান, তিনিসহ এই ঘাটে চার জন মাঝি নৌকা চালান। মাঝে মাঝে তিন জনও চালান। সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে এই ঘাটে নৌকা চলে রাত ১১টা পর্যন্ত। তার মধ্যে মাঝিরা সময় ভাগ করে নেন। সংসার কিভাবে চলে- প্রশ্নের উত্তরে হতাশা নিয়ে বলেন, ‘এই চলে কোনো মতে। এটাও আবার কখন বন্ধ হয়ে যায়।’
মোখলেছ উদ্দিনের নৌকার যাত্রী সোহরাব হোসেন থাকেন মানিকনগর, চাকরি করেন দিলকুশায়। প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে পার হন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নৌকা দিয়ে গেলে সময় বাঁচে আবার খরচও কম, হাঙ্গামা নেই।’ আরেক যাত্রী আবুল কালাম বলেন, ‘এই গুদারাঘাটে এলেই গ্রামের কথা মনে পড়ে, খুব ভালো লাগে।’
ঘাটে কথা হয় পরিচালনার দায়িত্বে থাকাদের একজন আমির হোসেনের সঙ্গে। পাশে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘ঐ অফিসের অনেক কর্তা আছেন, যারা চাকরি জীবন শেষ করে ফেলেছেন কিন্তু এই গুদারাঘাট সম্পর্কে কিছু জানেন না। প্রায়ই অনেকে এসে অবাক হয়ে যান যে, ঢাকায় এখনো নৌকা চলে, তাও আবার মতিঝিলে!’