রবীন্দ্রনাথের শৈল অবকাশ শিলং

বিবিধ, ফিচার

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 14:45:16

মেঘ-পাহাড়ের মায়া কাটিয়ে শৈলশহর শিলং পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা। গাড়ির ভেতর থেকেই স্ট্রিমলেট ডেখার মালবিকা নামে কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন কখনো খাসি ভাষায়, কখনো ইংরেজিতে। বুঝলাম, আমাদেরকে এই নামের কারও সঙ্গে হয়তো পরিচিত করাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি পাইন-ইউক্যালিপটাস গাছ পেরিয়ে একটি চমৎকার বাংলোর তোরণ দিয়ে ঢুকতেই নিমজ্জিত হলাম পরাবাস্তবতায়। বাংলো চত্বরের আলো-আঁধারির নির্জনতায় আমাদেরর অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে, জায়গাটির নাম ব্রুকসাইড। স্ট্রিমলেট গাড়ি থেকে নেমেই অন্ধকার থেকে আলোর সামনে বেরিয়ে আসা এক নারীকে ডেকে বললেন, মালবিকা তুমি এসেছ? গাড়ি থেকে নামতেই এক ভদ্রমহিলা করজোর করে নমস্কার জানিয়ে বললেন, আমি মালবিকা, মালবিকা বিশারদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্ট গ্যালারি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত।

বাংলোর আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে স্বাগত জানালেন রবীন্দ্রনাথ

 

বুঝতে বাকি রইলো না, বিশ্বকবি নির্জনতার খোঁজে তিনবার শিলংয়ের শৈল বাসের সময় যে বাংলোটিতে প্রথম থাকতেন, সেখানে চলে এসেছি।

আরও পড়ুন: মেঘপাহাড়ের ডাক (ভ্রমণগদ্য-মেঘের বাড়ি মেঘালয়-১)

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯,১৯২৩ এবং ১৯২৭ সালে তিনবার শিলং আসেন এবং কিছুদিন করে বসবাস করেন। কবির জনপ্রিয় উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র অমিত লাবণ্যের রোমান্টিকতায় শিলং বাঙ্ময় হয়ে অমর হয়ে রয়েছে। বিশ্বকবি একান্ত নির্জনতায় কিছু কাজের জন্য ১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর কবি রেলে চড়ে আসাম হয়ে শিলংয়ে পা রাখেন। তিনি পাইন গাছের আলো ছায়া বেষ্টিত ব্রুকসাইড বাংলাতে ওঠেন এবং একাধারে তিন সপ্তাহ কাটান। নির্জনতার হাতছানিতে কবি ১৯২৩ সালে আবার শিলং আসেন এবং রিলবঙের ‘জিতভূমি’ নামের বাড়িতে মাস দুয়েক কাটান। ১৯২৭ সালের মে মাসে কবি তৃতীয়বার শিলং আসেন। এবার তাঁর বসবাস ছিল লাইটুমুখরা আপল্যান্ড রোডের ‘সলোমন ভিলা’। পরে এই বাড়ি বিক্রয় সুবাদে বাড়ির নাম হয় সিধলি হাউজ।

আইসিসিআরয়ে চা পানের সময়

 

রবীন্দ্রনাথ ‘যোগাযোগ’ ও ‘শেষের কবিতা’য় তাঁর শৈলশহরে বসবাসকে অমর করে রেখেছেন। শেষের কবিতার নায়ক নায়িকা অমিত লাবণ্যের যে পরিচয়ের পটভূমিতে রয়েছে শিলংয়ের ব্রুকসাইড এলাকার রাস্তা।

আরও পড়ুন: মাওলিননংয়ের পথে....(মেঘপাহাড়ের ডাক-২)

‘আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা, ডানদিকে জঙ্গলে ঢাকা খাদ। এ রাস্তার শেষ লক্ষে অমিতের বাস। যেখানে যাত্রী সম্ভাবনা নেই, তাই সে আওয়াজ না করে অসতর্কভাবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলেছে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে এসেই দেখল, আর একটি গাড়ি উপরে উঠে আসছে। পাশ কাটাবার জায়গা নেই। ব্রেক কষতে কষতে গিয়ে পড়ল তার উপরে...পরস্পর আঘাত লাগল, কিন্তু অপঘাত ঘটল না। একটি মেয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। দুর্লভ অবসরে অমিত তাকে দেখল। ....অমিত টুপিটা গাড়িতে খুলে রেখে তার সামনে চুপ করে এসে দাঁড়াল। অমিত মৃদুস্বরে বললে, “অপরাধ করেছি”। মেয়ে হেসে বললে, ''অপরাধ নয় ভুল। সে ভুলের শুরু আমার থেকেই''।‌‌’

চিত্রশালায় রবীন্দ্রনাথের আঁক শিল্পকর্মের সঙ্গে

 

শেষের কবিতার এই শুরু ব্রুকসাইডের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায়। এই উপন্যাসের প্রেম-রোমাঞ্চ ঘনীভূত হয় শিলংয়ের পটভূমিতে।

আরও পড়ুন: শৈলতলে ঝরনার কলধ্বনি-লিভিং রুট ব্রিজ (মেঘপাহাড়ের ডাক-৩)

মালবিকা বিশারদ আমাদের স্বাগত জানিয়ে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত রুকসাইড বাংলোর ভেতরে নিয়ে গেলেন। বাড়িটি সরকারে তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সেখানে তিনটি ঘরে একটিতে একটি পুরনো আমলের খাট রাখা আছে। তবে সেটিতে বিশ্বকবি থাকতেন কিনা তার প্রমাণ নেই। দরজা দিয়ে ঢোকার পরের কক্ষ এবং ভেতরের লম্বা মতো একটি বড় কক্ষ মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে আর্ট গ্যালারি। স্থানীয় শিল্পী ও নবীন শিল্পীদের আঁকা গোটা চল্লিশেক পেইন্টিং ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বড়ঘরের মাঝখানে কয়েকটি সোফা পাতা। সেটি এই বাড়ি সংস্কারে সময় কেনা, কবির ব্যবহৃত নয়। পেইন্টিংয়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের নিজের আঁকা প্রতিকৃতিসহ পাঁচটি ছবির কপিও প্রদর্শিত হচ্ছে। টেগর আর্ট গ্যালারি হিসাবে এটি সংরক্ষণ করছে মেঘালয় সরকার শিল্প-সংস্কৃতি অধিদফতর।

আরও পড়ুন: মেঘের সঙ্গে মিতালি (মেঘপাহাড়ের ডাক-৪)

মালবিকা বিশারদ আমাদের ঘুরিয়ে দেখানোর সময় ব্রুকসাইড বাংলো সংরক্ষণের ইতিহাস তুলে ধরছিলেন। জানালেন, অনেকদিন সংগ্রাম করে এটি সংরক্ষণ করা গেছে। এই রবীন্দ্রস্মৃতিকে পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে আরও বহু প্রস্তাবনা সরকারে কাছে দিয়েছেন। কলকাতার মেয়ে মালবিকা বহুদিন ধরে শিলংবাসী। ‘রবীন্দ্রনাথ এবং শৈলবাস শিলঙ’ নামে গবেষণামূলক বই লিখেছেন। শিলংয়ে রবীন্দ্র স্মৃতিকে সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছেন। বললেন, শিলংয়ে রবীন্দ্রস্মৃতিবজড়িত বহু জায়গার মধ্যে এই একটিকে মাত্র সংরক্ষণ করা গেছে।

পুরনো আমলে কাঠের খাট-তবে বিশ্বকবি ব্যবহার করেছেন কিনা-তার প্রমাণ নেই

 

বাংলোর সামনে প্রশস্ত চত্বরে বিশ্বকবি দণ্ডায়মান। কবির আপাদমস্তক ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে ২০১১ সালের ৯ মে। গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু নিচে মেঘালয়ের বিধানসভা। রবীন্দ্রভক্তদের দাবি-যেহেতু শিলংয়ের অন্য রবীন্দ্রস্মৃতিগুলোকে যেহেতু সংরক্ষণ করা যায়নি, তাই বিধানসভা সরিয়ে নিয়ে ভবনটিকে বাংলোর অন্তর্ভুক্ত করে লাইব্রেরি, গবেষণাকেন্দ্র, মিলনায়তন ইত্যাদি সমবায়ে পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রস্মৃতি প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বকবির পদস্পর্শে শিলং বা মেঘালয় সমৃদ্ধই হয়েছে। তাছাড়া হালে এ অঞ্চল পর্যটকদের অবারিত করায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের স্রোতে এখানকার অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের এই স্মৃতি এর ব্রান্ডিং ভ্যালু বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত স্থান দর্শনীয় স্থান বটে।

মালবিকা কথা বলতে ভালবাসেন। শিলংয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠা করা, এ নিয়ে গবেষণা করা, এ নিয়ে দাবি দাওয়া তোলার ক্ষেত্রে যেসব মানুষ কাজ করছেন-মালবিকা তাদের অগ্রবর্তী। মালবিকা বলতে থাকেন, আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি।

ব্রুকসাইড বাংলোর প্রবেশমুখে পর্যটকদল

 

ব্রুকসাইড বাংলোর পেছনের দিকেও আরেকটি চত্বর। তিনটি কক্ষ। সেখানে আইসিসিআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স)য়ের অফিস ও লাইব্রেরী। মাঝখানের ঘরটিতে কয়েকটি সোফা পাতা। একদিকে আলমিরাতে কিছু বইপত্র, দেয়ালে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি টাঙানো। চিত্রশালা থেকে বের হতে হতে খাসি মেজবানগণ আগেই সেখানে গিয়ে বসেছিলেন। পরে আমরা যোগ দিলাম। গারো একটি ছেলে ভেতর থেকে চা বানিয়ে নিয়ে এলো। চা পানের সময় মালবিকা বিশারদ শিলংয়ে রবীন্দ্র স্মৃতিকে উদ্ধারের নানা গল্প বলছিলেন। চা পান শেষে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম। চত্বরে দাঁড়িয়ে মালবিকা বিদায় জানালেন। যে রাস্তায় গাড়িতে গাড়িতে ধাক্কা লেগে বিশ্বকবির অমর নায়ক-নায়িকা অমিত- লাবণ্যের পরিচয় হয়েছিল, সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের গাড়ি অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর