মেঘালয়-স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট

, ফিচার

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 01:54:21

মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সকালটি বড় মনোরম হয়ে ধরা দিলো। সচরাচর মেঘলা দিন আজ ঝলমলে রোদের ঝিলিক। তবে ভ্রাম্যমাণ মেঘের ভেলায় তা আবার মাঝে মাঝে ছায়াময় হয়ে ওঠে। বিগত সন্ধ্যায় শিলং পৌঁছে এর রাত্রির রূপটা দেখেছি মাত্র। আসল চিত্রটি চোখের সামনে এলো সকালে। সাতসকালে শৈলকন্যা শিলংয়ের রাস্তায় রাস্তায় ইউনিফর্ম পরা স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের কলতান।

হেঁটে বা গাড়িতে ছুটেছে শিক্ষালয়ে। অফিসগামীরা ছুটছে ব্যক্তিগত গাড়ি, ট্যাক্সি বা পাবলিক বাসে। পাহাড়ি সরু রাস্তার পাশে, আবাসিক পাড়াগুলোতে দোকানের ছড়াছড়ি। নাক বোঁচা, ছোট চোখের খাসি- গারো মেয়েরাই সেগুলো চালাচ্ছে। পথে পথে বাঁধভাঙা মানুষের জোয়ার। রাস্তাঘাট ছেলেদের তুলনায় কর্মমুখর লাস্যময়ী মেয়েদের কলহাস্যে মুখর। দেখেই বোঝা যায় মেঘের মেয়ে মেঘালয় কন্যাশাসিত সমাজের আওতাভূক্ত। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ধারায় চলছে এই শহর। 

পাহাড়ি উপত্যকার শহরটিতে এশিয়ার বৃহত্তম গলফ কোর্স, ক্যান্টনমেন্ট, মন্দির, মসজিদ, গির্জার ছড়াছড়ি। আছে স্টেডিয়াম। সিএম হাউজ, গভর্ণর হাউজ, হাইকোর্ট, বিধানসভা, সেক্রেটারিয়েট নানা সরকারি দফতর। শিক্ষার জন্য রয়েছে সেন্ট এডমন্ড, সেন্ট এ্যান্থনি, সেন্ট মেরি স্কুল ও কলেজসহ অসংখ্য স্কুল কলেজ। শিক্ষার পঁচাত্তর শতাংশ। উচ্চশিক্ষার জন্য রয়েছে নর্থ ইস্টার্ণ হিল ইউনিভার্সিটি-নেহুসহ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল কলেজ। বিশ্ব পরিব্রাজকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকায় শহরের পাড়ায় পাড়ায় হোটেল-রেস্তোরা। আছে পুলিশ বাজার নামে সিটি সেন্টার। শহরের আনাচে কানাচে বাজার, শপিং মল। পাহাড়ি খাদ, আঁকাবাকা রাস্তা, লেক, গার্ডেন, পাইনগাছের ঘনবন শৈলশহরটিকে দিয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। এর আকাশে সারাক্ষণ মেঘরোদ্রের লুকোচুরি। কখনো মেঘ, কখনো রোদ্দুর, কখনো ঝুমবৃষ্টি এর জলহাওয়ায়। প্রাকৃতিক এসি শহরটিকে প্রকৃতিগত দিক থেকে নাতিশীতোষ্ণ করে রেখেছে। আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে গিয়ে কখনো ওপর থেকে নিচে শহরের দালানকোঠা দেখা যায়। আবার একই রাস্তা নিচের দিকে নেমে গেলে চোখের তারায় শহরকে দেখা যায় ওপরের পাহাড়ি ঢালে।

মেঘালয় ও শিলংকে স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট নামে খাতি দিয়েছে বৃটিশরা। এর দৃষ্টিনন্দন উপত্যকা, পাহাড়ি রাস্তা, নয়নাভিরাম মেঘ, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া, অগুণতি জলপ্রপাত, ঘন পাইনবন এসব একমাত্র স্কটিশ হাইল্যান্ডের সঙ্গেই তুল্য। এখানে যে ১৮ হোল গল্ফকোর্স আছে, তাও এডিনবরা সংলগ্ন ডালকিত এর গল্ফকোর্স এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া পাহাড়ে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে মোট ১১ টি জেলা নিয়ে মেঘালয় রাজ্য। ভারতের লোকসভার দুটি আসন শিলং ও তুরা। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া জাতিসত্তাপ্রধান মেঘালয়ের আদিবাসীদের বেশিরভাগ খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত। শিলং শহরসহ দূর্গম পাহাড়ি গ্রাম পর্যন্ত চার্চ রয়েছে। হিন্দু,মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন এবং প্রাচীন ধর্মাবলম্বীও রয়েছে। এখানকার জাতিসত্তা খ্রীষ্ট ধর্মের যে শাখাটিতে ধর্মান্তরিত হয়েছে তাকে প্রেসবাইটেরিয়ান্স বলা হয়। যা বৃটেন বিশেষ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডে অনুসরণ করা হয়।

স্কটল্যান্ড অব দ্য ইস্ট-মেঘালয়ের প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে রাজধানী শিলং ছাড়াও রয়েছে নংপোহ, তোরা, উইলিয়ামনগর, রসুবেলপাড়া, নংসতৈন, নংকসেহ, আমপাতি, জোয়াই, বাঘমারা, সোহরা (চেরাপুঞ্জি), ডাউকি।

মেঘালয় উত্তরপূর্ব ভারতের পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র। সব ঋতুতেই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লাখ লাখ পর্যটক ছুটে আসছে। ছুটে যাচ্ছে মেঘালয়ের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে। এই রাজ্যের সোহরা বা চেরাপুঞ্জি বৃষ্টির বৃষ্টি রাজধানী। মেঘালয় নামটির হিন্দী অর্থ মেঘের আলয়। বাংলা ভাষায়ও তাই। রাজ্যের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক জলপ্রপাত, লেক, শেকড় সেতু, পরিচ্ছন্ন গ্রাম, পাথুরে নদী, রোমাঞ্চকর ট্রেক, গ্রান্ড ক্যানিয়ন বা মহাগিরিখাদ, মেঘ-কুয়াশাময় পাহাড়ি ভিউপয়েন্ট এবং দূর্গম আদিবাসী গ্রাম অন্যতম। চেরাপুঞ্জির মেঘদল, বৃষ্টি, সেভেন সিস্টার ফলস, ওয়াই সো ডং ফলস, থাংখারাং পার্ক, মাসমাই কেভ, কোহ রামহাহ বা জায়ান্ট রক, বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট, ডাউকির উমগট নদী, মাওলিন্নং ভিলেজ, সোনংপেডেং, উমক্রেন ফলস, বরহিল ফলস, লিভিং রুট ব্রিজ বা জীবন্ত শেকড়সেতু, ওয়াহ রিম্বেন ফলস পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শিলংয়ের ওয়ার্ডস লেক, পাশ্ববর্তী নমপোহ’র উমিয়াম লেক, লাবানের গ্রান্ড মদীনা মসজিদ, ব্রুকসাইডের রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বাংলো, স্মিথ ভিলেজ, লেইটলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, রাসোং ভিলেজ পর্যটকদের টেনে আনে মেঘালয়ে।

আমরা হাঁটতে থাকি মেঘের বাড়ি মেঘালয়ের রাস্তায়। নাকবোঁচা, ক্ষুদ্রচোখের পাহাড়ি কন্যার ঢল দেখি। দোকানপাটেও তাদের আধিপত্য চোখে পড়ে। ঘোমটা টানা পর্দানশীন, সিঁদুরপরা হিন্দুবধু, টুপিওলা মুসলিম বা পাগিড়ধারি শিখদের দেখে এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গারো, খাসি, জৈন্তিয়া জাতিসত্তার কথা মনে উঠলে যে পাহাড়ি মানুষের চিত্র মনে ভাসে, মেঘালয়ের পাহাড়িরা এর উল্টো। এখানকার পাহাড়ি জাতিসত্তায় শিক্ষিত, আধুনিক ও মার্জিতসম্পন্ন এবং চমৎকার ইংরেজীতে কথা বলে। রাজ্যের সরকারি ভাষাও ইংরেজি। খাসি, গারো ও জৈন্তিয়ারা মাতৃভাষাও ব্যবহার করে। কদাচিৎ শিলংয়ের রাস্তায় পাহাড়ি আদিবাসীর পোশাকে বাঁশের ঝুড়ি পিঠে দুয়েকজন পাহাড়িকে দেখা যায়। তারা হয়তো দূর্গম গ্রাম থেকে রাজধানী শহরে আসা মানুষ। কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য।

আমাদের ছোট্ট পর্যটকদলটি ছোট পাহাড়ি শহরটির এ গলি ও গলি হাঁটি আর প্রতিটি কোণ উপভোগ করি। শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘমালা, বৃষ্টি, মেঘভেঙে ঠিকরে বের হয়ে আসা রোদ্দুর, এর ঠান্ডা বাতাস আমাদের মন প্রশান্ত করে দেয়।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর