কোহ রামহাহ ও কিনরেম ফলস

, ফিচার

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-08-31 11:21:39

চেরাপুঞ্জিতে গাড়ি থেকে প্রথম যে জায়গাটিতে নামলাম, তাকে অফবিট স্পট বললেই বেশি মানায়। এর নাম কোহরামহাহ বা মোট্রপ। কোহ রামহাহ আসলে দুইশ ফুট উচ্চতার এক দানবীয় গোলা আকৃতির পাথর। ওপরের শীর্ষটা গম্বুজের মতো। তলদেশ থেকে দুইশ ফুট উঁচু গোলাকার পাথর। পাহাড়ের ঢালে এমন একটি জায়গায় তা প্রাকৃতিকভাবে স্থাপিত হয়ে আছে, যার পাশে একই আকৃতির আরও দুটি ছোট পাথর, মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝর্ণার কলধ্বণি। জঙ্গলময় পাহাড়ি গিরি থেকে অবিরাম নেমে আসছে এই পানি। কোহ রাহমাহ বা পিলার রকের পাশ গড়িয়ে পড়ছে কয়েকহাজার ফুট নিচে। নিচে ঘনজঙ্গলময় দূর্গম প্রাকৃতিক নৈসর্গ। অদূরে চোখের সামনে বাংলাদেশের সমতলে বয়ে যাওয়া নদী।

আমাদের হোস্ট-কাম গাইডগণ বলছেন, ‘বাংলাদেশে এই উচ্চতার সমান্তরালে মেঘ জমে থাকে। এখানে বাংলাদেশ দেখার জন্য যারা আসেন, মেঘ থাকলে তারা পরিষ্কার দেখতে পান না। তোমাদের ভাগ্য ভাল, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ওপর মেঘ নেই।‘ গাড়ি চালক, এককাঠি সরেষ। আগ বাড়িয়ে বলল, ‘ওই যে বাঁয়ের দিকে একটু দূরে তাকান, সাদা সাদা বিল্ডিং, ওইটাই সিলেট।‘ দেখলাম সত্যিই তো সিলেট দিব্যি দেখা যাচ্ছে অদূরে। আর আমাদের নিচে জঙ্গলের ভিতর থেকে বাংলাদেশমুখো স্রোতস্বিনী ছুটে চলেছে সমতল বাংলাদেশের দিকে, তা জাদুকাটা নদী হয়ে ছাতক, কোম্পানিগঞ্জের ভূগোল মাড়িয়ে পৌঁছেছে সুরমায়।

কোহ রামহাহ’র ঝর্ণার ওপর তৈরি করা হয়েছে ছোট্ট কংক্রিটের কালভার্ট। তা সংযুক্ত করেছে একবিঘার মতো আয়তনের একটি উঁচু টিলাকে। এর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনি। এটা ভিউপয়েন্ট। ভিউপয়েন্ট বা প্রেক্ষণবিন্দু হলেও তা কেবল বাংলাদেশের সমতল,পাশ থেকে কোহ রামহাহ রক দেখা আর জঙ্গলময় প্রকৃতি ছুঁয়ে সমতল থেকে উড়ে আসা মেঘলা বাতাস উপভোগ। আরও বাড়িয়ে বলতে গেলে ঝর্ণার উৎসের কলধ্বণি শুনে মাতোয়ারা হওয়া। নিচে গড়িয়ে যাওয়া অবিরাম জলধারার উৎসের ভিত্তি করে তৈরি হচ্ছে যে নয়নাভিরাম জলপ্রপাত, তা দেখতে হলে যেতে হবে অন্য ভিউ পয়েন্টে। মানুষের দেখার চোখটি এরকমই। একেকজন যেমন একেকভাবে কোনকিছু দেখে। তেমনি একেক জায়গা থেকে কোন দৃশ্য একেকভাবে দেখা যায়। আমরা কোহ রামহাহ পাথর আর বাংলাদেশ ভিউপয়েন্ট দেখতে এসেছি, জলপ্রপাত নয়। যাহোক আমাদের পর্যটক দল ছোট্ট কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে নানাভঙ্গিতে ছবি তোলে। ব্রিজের নিচ দিয়ে ছুটে চলা ঝর্ণার পানিকে যতোটা ক্যামেরার ভিউয়ের ভেতর আনা যায় তার কসরত করতে থাকে।  নানা স্পটে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তোলে।  

আমি আর ভ্রমণসঙ্গী কামরুল হাসান কবিতা লিখি। প্রকৃতির অপত্যস্নেহের মধ্যে নেমে আমরা কোথাও হারিয়ে গেছি। ছবি তোলার হৈচৈ ছেড়ে আমরা দু’জন দুদিকে মগ্ন। আমি পানির কলতান শুনে টিলার বেষ্টনি পেরিয়ে আরেকটু ঢালুতে নেমে যাই। আবিস্কার করি টিলার নিচে ও আশপাশের খাদ দিয়ে অন্তহীন পানি নেমে যাওয়ার কলকল শব্দ। এটি কোহ রাহমাহ’র কাছ দিয়ে নামা ঝর্ণার চেয়ে আলাদা। এই পানিও কোন স্পটে গিয়ে হয়তো তৈরি করেছে চমৎকার জলপ্রপাত। খ্যাত জলপ্রপাত এর উৎসে অনতিক্রম্য গিরিখাদের ভেতর দিয়ে নেমে আসে যেসব নাম না জানা জলধারা, তার প্রত্যেকটিকে তো আর আলাদা নামে ডাকা যায় না ! আসলে প্রকৃতি অন্তহীন, অধরা, অবারিত। চলছে নিজস্ব ধারায়। নামের ছকে বেঁধে মানুষকে একে করে তুলেছে বাণিজ্যিক।

কোহ রামহাহ ভিউপয়েন্টে বাংলাদেশ দেখতে দেখতে এই প্রাচীন দানবীয়  পাথরটি সম্পর্কে খাসিদের প্রচলিত বিশ্বাস সম্পর্কে বলতে থাকেন আমাদের হোস্ট স্ট্রিমলেট ডেখার। তিনি শিক্ষিত গুণী মানুষ। খাসিদের ইতিহাস-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান টনটনে। বলেন, ‘এই পাথর ছিল এক লোভী শয়তানের মালিকানাধীন। অতি লোভে সে মানুষের সমস্যা তৈরি করতো। তার থেকে মুক্তির জন্য লোকজন তাকে আয়রন ও ধারালো নখ মিশ্রিত খাবার খেতে দেয়। এই খাবার খাওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। তার ফেলে যাওয়া ঝুড়িটি পরে এই  মহাপাথরের আকৃতি ধারণ করে’। গাড়ির কাছে উঠে আসার সময়ও দেখি, ডেখারের বলা ইতিহাসটি সাক্ষ্য দিচ্ছে  রাস্তার ওপর টানানো একটি সাইনবোর্ডেও।

জায়ান্ট রকে আমরা কোন পূজার  সামগ্রী দেখলাম না। পাহাড়ের ঢালু, দূর্গম রাস্তা পেরিয়ে এখানে খুব কম পর্যটক আসে। নৈসর্গিক শোভাময় জায়গাটি পর্যন্ত রাস্তা, নিরাপত্তা বেষ্টনি, ঝর্ণার ওপর ছোট কালভার্ট বানিয়ে পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যেই সীমিত রেখেছে খ্রীষ্ট ধর্ম অনুসারী খাসিরা। তা দেখতে দেখে ভ্রমণতৃষ্ণা মেটানোর  ক্ষেত্রে ধর্মের ভেদাভেদ নেই।

কোহ রামহাহ পাহাড়-জঙ্গলের যে লোকেশনে, এর খুব কাছেই ভারতের সপ্তম বৃহত্তম জলপ্রপাত কিনরেম। পাহাড়ের ওপর থেকে একহাজার এক ফুট উচ্চতা ধারণ করে জলপ্রপাতটি ঘনঅরণ্যে  হারিয়ে যাচ্ছে।  ঢেউ খেলানো পাথুরে পাহাড়গাত্রে এটি তিনটি স্তুর তৈরি করেছে। ফলে এর সৌন্দর্য প্রলম্বিত। প্রথম স্তর থেকে চোখ সরিয়ে দ্বিতীয়টিতে সবশেষে এর তৃতীয় স্তরটির ঝলধারা গভীর অরণ্যে গিয়ে পড়ছে দেখা যায়। সোহরা-শেলা সড়ক আরও নিচে নেমে আবার ওপরে উঠে এঁকেবেঁকে এই জলপ্রপাতের তৃতীয় স্তরের ওপর দিয়ে চলে গেছে। প্রপাতের জলধারাকে অবাধ করতে রাস্তার ওপর বানানো হয়েছে সেতু। দূর্গম সড়কটি চলে গেছে বাংলাদেশের হালুয়াঘাট সীমান্ত পর্যন্ত। সারাক্ষণই এর ওপর দিয়ে গাড়ি, ট্রাক চলাচল করে। যাওয়ার আসার পথে সেতুর ওপর গাড়ি থামিয়ে বা গতি কমিয়ে যাত্রী ও চালকরা জলঝর্ণাটিকে একনজর দেখে নেয়। ব্রিজের সঙ্গে নিচে নামার সিঁড়ি ।  বড় বড় পাথরের মধ্যে এসে পড়ছে কিনরেমের পানি ফেনিলশুভ্র পানি। যারা এই স্পট ধেকে কিনরেম উপভোগ করতে চান, তারা পানিও ছুঁয়ে দেখতে পারেন। তবে এখান থেকে শেষের স্তরটিই কেবল দৃষ্টিগোচর হয়।

মনে পড়ে, ইউরোপের বৃহত্তম জলপ্রপাত সুইজারল্যান্ডের সাফাউজেনে অবস্থিত রাইনফলের কথা। রাইনফল সংলগ্ন রাজপ্রাসাদের নাম স্কলসি লাউফেন ক্যাসেল। এই নামেই ছোট্ট স্টেশনও। দ্রুতগামী ট্রেন রাইনফল দর্শনাকাঙ্খী যাত্রীদের জন্য একমিনিটের বিরতি দেয় স্কলসি লাউফেনে। প্রাসাদের নিচ দিয়ে নির্মিত সুরঙ্গপথ পার হয়ে ট্রেন রাইন নদীর সেতু অতিক্রম করে যায়। রাইন নদীর পানি পাহাড়ে বাঁক নিয়ে আকস্মিক তৈরি করেছে জলপ্রপাত। নদী অতিক্রম করে ট্রেন মূহুর্তে গিয়ে থামে নৈহাউজেন স্টেশনে। সেতু পার হওয়ার সময় জলপ্রপাতের কলধ্বণি আর ফেনায়িত শুক্র জলরাশি দেখে যাত্রীরা ঘোরের মধ্যে পড়ে। রাইনফল অবশ্য চেরাপুঞ্জির মতো প্রাকৃতিক না। একে কেন্দ্র করে খানাপিনা, রাফটিং, পাটাতনে দাঁড়িয়ে উৎক্ষিপ্ত ফেনিল শুভ্র পানি ছোঁয়া, ছবি তোলার মতো বাণিজ্যিক প্যাকেজের মধ্যে আটকে দেয়া হয়েছে।

আমরা কিনরেম দর্শনে গেল পাশ্ববর্তী থাংখারাং পার্কে। আধ কিলোমিটারের মতো সমতল রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের দিকে গেলেই থাংখারাং। বড়সড়ো চত্ত্বরের পাশে গুটিকয়েক হস্তশিল্পের দোকান। পার্কের প্রবেশপথে টিকেট কাউন্টার। দশ টাকা করে এন্ট্রি ফি, ক্যামেরার জন্য বাড়তি টাকা। পাঁচ হেক্টরের বেশি আয়তনের থাংখারাং পার্কের শেষ মাথায় লুকআউট ডেক। বলতে পারি দৃশ্য পাটাতন। এর বেষ্টনিগুলো বাংলাদেশের পতাকা লাল-সবুজ রঙে রঞ্জিত। কিনরেম ফলসকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে যারা ছবি-সেলফি তুলতে চায়, তাদের জন্য জায়গাটি আদর্শ। এখান থেকে বাংলাদেশও দেখা যায়। আমাদের সঙ্গী কন্যা, জায়া, জননীদের আর পায় কে! তাঁরা ছবি সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরাও তাই।

পার্কে ঢোকার মুখে জলিকে একটি ক্যাপ কিনে দিয়েছিল খাসি হোস্ট বাখিয়া মুন। ইতোমধে তাঁর সঙ্গে বেশি ভাব হয়েছে জলির। ক্যাপের রঙ তাঁর পছন্দ না হলেও দোকানেও ভিন্নরঙা ক্যাপ ছিল না।  প্রসঙ্গ উঠতেই স্ট্রিমলেট ডেখার নিজের মাথার হলুদাভ ক্যাপটি খুলে জলির মাথায় পরিয়ে দিলো। জলি মহাখুশি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর