চেরাপুঞ্জি: বৃষ্টির বিশ্ব বসতি

, ফিচার

মাহমুদ হাফিজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | 2023-09-01 04:19:52

চেরাপুঞ্জিকে আমি নাম দিয়েছি বৃষ্টির বিশ্ব বসতি। এখানে বৃষ্টি আকাশ থেকে পড়ে না। যে মেঘ থেকে আমরা বৃষ্টি ঝরতে দেখি, সে মেঘেরা বাস করে সেখানে। আর মেঘবৃষ্টির পরিমাণ এতো বেশি যে বহু আগে তা বিশ্বরেকর্ড করে বসে আছে। সে হিসেবে আমরা আজ বৃষ্টির বিশ্ব বাড়ির অতিথি। কিন্তু বৃষ্টি কই? ঘনমেঘে চারপাশ ছেয়ে আছে, বৃষ্টির কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুরা ফেসবুকে আমার চেক ইন আর গুগল মানচিত্রের লোকেশন দেখে ‘ওখানে বৃষ্টি পাবে না, চেরাপুঞ্জিতে এখন বৃষ্টি হয় না’ বলে যে মন্তব্য করেছিল, তাই কি তবে সত্য হতে চলেছে? রেইনকোট আর ছাতাগুলো টাটা সুমোর পেছনের বুটে পড়ে আছে। গায়ে চড়ানো তো দূরে থাক, এগুলোর মোড়ক পর্যন্ত খোলা হয়নি। অথচ যাওয়ার প্রস্তুতির সময় ভ্রমণসঙ্গী গিন্নী ও কনিষ্ঠপুত্রধনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছি, ‘রেইনকোট-ছাতার এন্তেজাম, কারণ এবারের ভ্রমণ বৃষ্টিমুখর। বৃষ্টি দেখতেই শিলং যাচ্ছি’।

থাংখারাং পার্কের লুকআউট পয়েন্ট থেকে কিনরেম ফলস দেখে বের হতেই মেঘের ঘনঘটা। বৃষ্টি এলো এলো। বৃষ্টিকে স্বাগত জানাচ্ছি বটে, উদ্বেগও আছে। ভারিবর্ষণ শুরুর আগেই শেলা-সোহরা সড়কের কাঁচা অংশ অতিক্রম করে ওপরের পাহাড়ের দিকে উঠে যেতে হবে। আসার সময় সড়কের কাঁচা অংশের যে অবস্থা দেখেছি, ঢলে তা যে গাড়ি চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।

পিচঢালা নতুন রাস্তায় এলেই গাড়ি ঊর্ধ্বগামী হতে থাকে। সেভেন সিস্টার্স ফলসের এর দিকে এগোতে থাকলেই গাড়ির মধ্যে তুসুর চিৎকার ‘মেঘ মেঘ, পাহাড়ের নিচে নেমে যাচ্ছে মেঘ’। সবাই তাকিয়ে দেখি, ডানের  উপত্যকাজুড়ে মেঘের ভেলা পাহাড়শীর্ষসমূহের নিচের দিকে পরিভ্র্রমণরত। সবুজ পাহাড়ের কোলে শুভ্র মেঘের এই পরিভ্রমণ চোখকে প্রশান্ত করে দেয় আমাদের। চোখের সামনে ইউরোপীয় সৌন্দর্য দেখে আমরা গাড়ি থেকে না নেমে আর স্থির থাকতে পারি না। জায়গাটির নাম নেই। আমি গুগলে দেখলাম, কিছুদূরে একটা নামের উল্লেখ রিংগুড নামে একটা নামের উল্লেখ আছে। সেভেন সিস্টার্স ফলস থেকে জায়গাটি অন্তত তিন কিলোমিটার নিচের দিকে।

ডাইনের ভ্যালির দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘপাহাড়ের বিরামহীন লুকোচুরি। কখনো পাহাড়ের নিচে নেমে যাচ্ছে মেঘ। কখনো আবার পাহাড়কে চুমু দিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। কোনো কোনো মেঘের দল একস্থানে ভেসে রয়েছে। কিছু মেঘ উড়ছে একাধিক পাহাড়ের মাঝখানে ঢেউখেলানো ভাঁজে ভাঁজে। এই অভূতপূর্ব চোখের সাড়ে তিন ইঞ্চি লেন্সে তা রেকর্ড করে মস্তিষ্কের ডার্করুমে রেখে দেই। এই লেখাটি আসছে মস্তিষ্কের ডার্করুম থেকে সেই চলচ্ছবি ডেভেলপের মধ্য দিয়ে। মোবাইল ক্যামেরায় কিছু মেঘকে ক্যামেরাবন্দী করতেও আমাদের  দলটি ভুল করলো না। এই দৃশ্যপটটির মজা হচ্ছে এখান থেকে সেভেন সিস্টার্স ফলসটিও দেখা যায়। তবে সেভেন সিস্টার্স যে চুনাপাথরের পাহাড় থেকে নামছে, জায়গাটি তার নিচে বলে জলপ্রপাতটি ওপরের দিকে দৃষ্টিগোচার হয়।  

আমরা পাহাড়ি বাঁক নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেভেন সিস্টার্স বা মাওসমাই জলপ্রপাতের ভিউপয়েন্টে পৌঁছাই। রাস্তার পাশে বড়সড়ো পার্কিং, দোকানপাট। গাড়ি পার্ক করার জলপ্রপাত উপভোগ দেখতে নেমে পড়লাম আমরা। আমরা বলতে, চারজন। জলি,  তুসু আমি আর কবি কামরুল। হোস্টগণ অনেকবার আসায় গাড়িতেই বসে রইলেন। ঝির ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। তবে আমরা ছাতা বা রেইনকোট তখনো বের করিনি। জামাকাপড়ের ওপর যে বৃষ্টিসহনক্ষম জ্যাকেট আছে তা দিয়েই চালানো যাচ্ছে। আমার গায়ে লাল জ্যাকেট। যাত্রাকালে জলিকে বলেছিলাম, মেঘরাজ্য মেঘালয়ের সব ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড হবে সবুজ। সবুজের ওপর কন্ট্রাস্ট করতে গায়ের পোশাক হতে হবে জুৎসই রঙের, তাতে ছবি ভাল ফুটবে। সেমতে, জামার ওপরে চাপিয়েছি লাল জ্যাকেট। যে লোকেশনে দাঁড়িয়েই পোজ দিই না কেন ছবি হচ্ছে ‘সেইরকম’।

রেলিঙঘেরা ভিউপয়েন্টের নিচে পাহাড়ি উপত্যকা। অদূরে পাহাড়ের গা’ দিয়ে নামছে সাত সাতটি জলপ্রপাতের ধারা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, হা হয়ে ক্ষণিক সবকিছু ভুলে দাড়িয়ে থাকতে হয়। একহাজার ৩৩ ফুট উচ্চতার সেভেন সিস্টার্স বা মাওসমাই ফলস ভারতের অন্যতম দীর্ঘ জলপ্রপাতের মর্যাদা বহন করছে। জায়গাটি পর্যটকের পদভারের মুখরিত। ওয়াও ওয়াও ধ্বনি, আবাল বৃদ্ধ বণিতার গুঞ্জন, ক্যামেরা, ট্যাব, মোবাইলের ক্লিক ক্লিক। এখন প্রযুক্তির যুগ। মিডিয়া এখন আর সনাতনধারার পত্রিকা, বেতার, টেলিভিশনের মধ্যে সীমিত নেই। সোস্যাল মিডিয়া যুগে পর্যটন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে কেউ ফেসবুকে লাইভ দিচ্ছে, কেউ ক্যামেরার সঙ্গে সেলফি স্ট্যান্ড লাগিয়ে সেলফি তুলছে, কেউ জলপ্রপাত পেছনে রেখে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বর্ণনা দিয়ে ভিডিও করছে। নিশ্চিত ইউটিউব চ্যানেলে ছাড়া হবে এসব ভিডিও। প্রযুক্তিযুগে পর্যটনস্পটগুলোর চেহারাও গেছে বদলে গেছে। তুসু জলপ্রপাতকে পেছনে রেখে সেলফি তুলতে চেষ্টা করছে। আমি একজায়গায় ‘সেলফি ডেঞ্জার জোন’ লেখা সাইনবোর্ড দেখিয়ে তাকে সাবধান করে দিলাম।

দুপুরে শিলং থেকে বের হওয়ার সময় থেকে এখন পর্যন্ত চা খাইনি। ইতোমধ্যে মধ্যাহ্নের সময়ও চলে যাচ্ছে। হোস্টগণ বাসা থেকে খাবার দাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। স্ট্রিমলেট ডেখার আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছেন, চেরাপুঞ্জির ‘দোকান’ সড়কে তাঁর বোনের বাড়ি আছে। সেখানে দুপুরের খাওয়ার পর চা পানের ব্যবস্থা হবে। আমাদের পেটে ততোক্ষণে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে। আমরা তা ভুলে আছি উদার প্রকৃতি দেখার ঘোরে। খাবার কথা মনে হলে, আগে খাওয়ার কাজটি সারার জন্যই সবাই একমত হওয়া গেল। চেরাপুঞ্জি সদরের ডুকান সড়কে ডেখারের বোনের বাড়ি। গাড়ি দ্রুত সেদিকে ছুটে চললো।

এ সম্পর্কিত আরও খবর