মধ্যাহ্নভোজ ও চা পানের বিরতির জন্য স্ট্রিমলেট ডেখারের বোন ভিক্টোরিয়া কারশিংতোর বাসার দিকে গাড়ি ছুটে চললো। আমি আর জলি পেছনের সিটে। জলি ফিস ফিস অনুযোগ করলো ‘তোমার খবর আছে, কতবার বলেছি মেঘের আবছা আঁধারে আমার ছবি তুলে দিতে, তুমি কানে তুললে না’।
বললাম- ‘হবে হবে’।
তার সাফ জবাব- ‘কই, এখন তো আকাশে মেঘ বৃষ্টি কিছুই নেই। মেঘ পাবা কোথায়?’
দীর্ঘদিন বাচ্চাদের পড়িয়ে পড়িয়ে মনটি নরম মেঘের মতো হয়ে যাওয়া এই ভদ্রমহিলা মেঘ, বৃষ্টি, ফুল, পাখি, কোলের শিশু দেখলে ছবি তুলতে ব্যগ্র। আমার তা জানা থাকলেও যতোটা মনোযোগ স্ত্রীরা সাধারণত: পেয়ে থাকে, দল বেঁধে ভ্রমণে তা পায় না এবং এই ভ্রমণে সে নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। দর্শনীয় স্থানে নেমে সবাই ছবি, সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। কারও প্রতি কারও বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সুযোগ কম। কয়েকবার মেঘবৃষ্টির দেখা পাওয়া গেলেও মনের মতো ছবি তুলতে না পারায় আমাকে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে।
ঘটনা মিরাকলের মতোই। সেভেন সিস্টার্স ভিউপয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরুর পরই মেঘবৃষ্টি উধাও। রোদ না উঠলেও চারদিক পরিষ্কার। তবে আমি চিন্তিত না। চেরাপুঞ্জিতে প্রথম এলেও জানি এখানে এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। দেখা যাবে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হয়তো মেঘ বৃষ্টির দেখা পাওয়া যাবে। সময়ের ফারাক তিন মিনিট হোক আর তিরিশ মিনিট।
ডেখারের বোনের বাসা চেরাপুঞ্জির ডুকান রোডে। চেরাপুঞ্জির একদম কেন্দ্র বলতে যা বোঝায়, সেখানে। সোহরা-শেলা সড়ক থেকে বাঁয়ে সোহরা-লেইটকিনসো সড়কে ঢুকে দ্বিতীয় গলিটিই ডুকান রোড। গাড়ির ভেতর থেকে স্ট্রিমলেট এর আরেক বোন- আমাদের আজকের সহযাত্রী ‘ডোডো’ নির্দেশনা দিতেই গলির দু’তিনটি বাড়ির পরে সুদৃশ্য একটি বাড়ির সামনে গাড়ি থেমে গেল। ওপরে টিন, নিচে কংক্রিটের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সামনে মধ্যবয়স্ক মার্জিত রুচির সুশ্রী এক ভদ্রমহিলা দু’হাত উঁচিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে। সবাই নেমে দ্রুত গেট দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ও জলি পেছনের আসন থেকে পরে নামতেই দেখি স্বাগত জানাতে এসেছে মেঘদল। এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। প্রধান সড়ক দিয়ে আসার সময়ও চারদিক পরিষ্কার ছিল। আকস্মিক ডুকান রোডে ভিড় করেছে দুনিয়ার সব মেঘদল। চারদিক অন্ধকার। ঠাণ্ডা তুলতুলে মেঘ ও কুয়াশা আমাদের ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে ধীরে। কিংবা আমরাই মেঘের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। ভাবলাম, ‘বাঁচা গেল’।
সহসাই ভেতরে না ঢুকে ফটোসেশন কিংবা পুরোবস্তুর শুটিংয়ে লেগে গেলাম। জলিকে বললাম, গলির মাথায় হেঁটে গিয়ে আমার দিকে আস্তে আস্তে ফিরে আসতে। জলি সেভাবে এলো। আমি বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্লিকের পর ক্লিক করে যাচ্ছি। মেঘ ঘন ছিল। দৃশ্যমানতার হেরফেরে অপস্রিয়মাণ মেঘের বহুমাত্রিক ছবি এলো। প্রথম খুব ঝাপসা, তারপর আস্তে আস্তে পরিষ্কার ছবি।
ঘনমেঘের আস্তরণের মধ্যে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই কাপড়চোপড় ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মেঘ। ঠাণ্ডাও লাগছে বেশ। এই না হলে চেরাপুঞ্জি! ‘আমি আসছি’ বলে তাকে দ্রুত বাড়ির ভেতরে পাঠালাম।
শুটিংয়ে এবার আমার পালা। ভেতরের দিকে আগুয়ান পুত্রধন তুসুকে ডেকে নিলাম। তার প্রযুক্তিজ্ঞান টনটনে। ছবিও তোলে ভাল। আমিও দূরে গলির মুখে গিয়ে আবার ফিরে আসতে লাগলাম। মেঘের ঘনত্ব মাঝে মাঝে কমবেশি হয়। তাই ঘনমেঘে উড়ে আসার আশায় এরকম কয়েকবার করলাম। আমি ঘনমেঘের আবছা আঁধার থেকে হেঁটে ক্রমশ: বের হয়ে আসি ক্যামেরার দৃশ্যমানতায়। তুসু ক্লিক করতে থাকে পটাপট। মনে হচ্ছে, হিন্দু সিনেমার কোন নায়ক গল্পের প্রয়োজনে মেঘের ভেতর থেকে পরিচালকের নির্দেশে ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে। টেক ওয়ান, টেক টু, টে থ্রি আওয়াজে চলছে শুটিং।
ডুকান রোডটি এসময় বড় নির্জন। কদাচিৎ দুয়েকটি গাড়ি চলে। বিকেলের দিকে বলে হয়তো এই নির্জনতা। গলির মাথায় বসতি ঘন নয়। রাস্তার নির্জনতা পেয়ে ফটো শুটিং নির্বিঘ্নেই চললো। ছবি দেখে নিজের গোবেচারা চেহারা নিজেই চিনতে পারছি না। ছবি ফেসবুকে পোস্ট হলে একজন কমেন্টবক্সে লিখলেন ‘হিরো নাম্বার ওয়ান’। লাজুক ভঙ্গিতে অস্ফুট ধ্বনি করলাম- যাহ।
গেট পেরিয়ে খোলা বারান্দা। বারান্দার পেছনে ড্রইংরুম। ঢুকে দেখি আধুনিক ও শহুরে পরিবেশ। বেত ও কাঠের ডাবল সোফা সেট। মেঝেতে কাঠস্টাইলের রেক্সিন। দেয়ালগুলো ডিজাইন করা কাঠে মোড়ানো। দেয়ালে বসানো শোকেসের মধ্যে কাঁসাপিতলের আসবাব। খাসি আতিথ্যগ্রহণে এসে শহুরে আধুনিকতা দেখে একরকম হতাশ হতে যাচ্ছি, তখন স্ট্রিমলেট বললেন, এই বাড়ি খাসি ঐতিহ্যের ছোঁয়া রেখেই সাজানো। শো কেসে প্রাচীন খাসিদের ব্যবহার করা কাঁসা পিতলের বাসন, ছাদ বা চাতালের দিকটা শীতলপাটির বুনন, দেয়ালসজ্জিত কাঠের আবরণে। শিলং শহরের খাসি বাড়িগুলোতেও আজকাল এগুলো নেই।
কিছুক্ষণ পর খাবার খাওয়ার জন্য ভেতরে ডাক পড়লো। ছোট্ট করিডোর পেরিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখি দেয়ালঘেষে চারদিকে চেয়ারপাতা। গৃহকর্তা ডেরিয়াস অটোমেটিক ইলেকট্রিক ওভেনে হাত-পা গরম করছেন। বাইরে থেকে আসায় তার হাত পা ঠাণ্ডা। জানা গেল, এখানে সংবছরই ঠাণ্ডা থাকে। আগুনের শেক দিয়ে হাত পা উষ্ণ রাখা বাসিন্দাদের অভ্যাস। পাশের চেয়ারে ডেরিয়াসের স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। দু’জনের আয়েশি ভঙ্গির পাশে বসেছেন আমাদের মেজবান দলনেতা স্ট্রিমলেট ডেখার। আমরা আসন নিতে নিতেই পাশের টেবিলে বসে প্লেটে প্লেটে খাবার পরিবেশন শুরু করেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুন। প্লেটে প্লেটে ভাত, ডিমসেদ্ধ, বানানা বল ওরফে কলা ভর্তা, আচার, ডাল।
গত কয়েকদিনে পরিচয় পাওয়া গেছে ভ্রমণসঙ্গী বাখিয়া মুনের। বয়সে অনেকটাই নবীন কলেজ শিক্ষক মুন সংসারী, করিৎকর্মা ও বন্ধু প্রিয়। বাড়ি থেকে নিজ হাতে রান্না করে মধ্যাহ্ন খাবার নিয়ে এসেছে। সঙ্গে প্লেট, চামচ আনতেও ভুল করেনি। তার ধারণা ছিল, ঝর্ণা, পার্কের উন্মুক্ত জায়গায় বনভোজন হতে পারে, তাই সব ব্যবস্থা। গাড়ির বুটে কয়েক ব্যাগে এসব রাখা ছিল। বনের বদলে বাড়িতে খাওয়ার আয়োজন হওয়ায় চালকের সহায়তায় ব্যাগগুলো ভেতরে আনা হয়েছে। ভাবলাম, একে বলে বরাত। পেটে ক্ষুধা আর খাবার দুটিই সঙ্গে করে নিয়ে এতক্ষণ ঘুরে বেরিয়েছি আমরা, ওপরের নির্দেশ আসেনি উদরপূর্তিরও ফুরসত মেলেনি।
ডাইনিং লাগোয়া রান্না ঘরের বেসিনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা। কবি কামরুল হাসান আগে আগে গিয়ে হাত ধুয়ে নোটবুক বের করেছেন। পাশের উনুনে চা বানানোয় নিয়োজিত লাজুক স্বভাবের তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করে টুকে নিচ্ছেন। সে পরিষ্কার হিন্দিতে বলছে, মেরা নাম দয়া।
আমি, কবি কামরুল হাসান আর ডেরিয়াস কাছাকাছি চেয়ারে বসেছি। চা পানের সময় স্ট্রিমলেট বললেন, ডেরিয়াস চেরাপুঞ্জির নামকরা টেইলরিং মাস্টার। স্যূট- কমপ্লিট এর স্পেশালিষ্ট। চেরাপুঞ্জিতে স্যূট-কোট বলতেই ডেরিয়াস। পোশাক আর মানুষ সিনোনিমাস হয়ে গেছে।
একথা শুনে ভ্রমণদলের কামরুল হাসান নড়েচড়ে বসলেন। ডেরিয়াসের সঙ্গে আগ্রহভরে আলাপ জমালেন। পেশায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সিগনেচার ড্রেস স্যূট টাই। এখানে এ্যাডেভেঞ্চার ট্যুরিজমে এসেও নিজের ড্রেসকোড থেকে বিচ্যুত হননি। ভারত বা চেরাপুঞ্জিতে এর দামদর, ফেব্রিক ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন করে ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
খাসি, বাঙালি, শিলং, চেরাপুঞ্জি, বৃষ্টি মুখরতা নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা চললো। বিদায়বেলায় গ্রুপ ফটো তোলার পর আবিষ্কৃত হলো ‘দয়া’র চেহারারই আরেক তরুণীর ছবি গ্রুপ ফটোতে। মনে হচ্ছিলো যমজ দু’জন। জিজ্ঞেস করে জানা গেল তার নাম ইভা। দয়া’র ছোট। সেও লেখাপড়া করছে। দুই মেয়ে নিয়ে ডেরিয়াস-ভিক্টোরিয়ার সুখের সংসার।
খাসি আতিথ্যে আমাদের মন উঠলো। চেরাপুঞ্জি গিয়ে দর্শনীয় স্থানকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ছবি তোলে অনেকেই, খাসি আতিথেয়তা ক’জন পায়!