এবার নতুন জুটি হিসেবে হিলারি-তেনজিংরা প্রস্তুত। পরিবেশ ও পরিস্থিতিও আজ অনেক অনুকূল। সুন্দর ঝকমকে সকাল। রোদের ঝিলিকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের মতো চকচক করছে হিমালয় শীর্ষের বরফখণ্ড। দলনেতার ইঙ্গিত পেলেই শুরু হবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের দিকে শতাব্দীর সেরা অভিযান। শুধু সঠিক ও যুৎসই সময়ের অপেক্ষা। তখনই আবার ঘটলো বিপত্তি।
প্রস্তুত হয়ে তাবুর বাইরে বেরিয়েই হিলারির মাথায় বাজ পড়ল। তিনি আবিষ্কার করলেন, তার চামড়ার বুটজোড়া বরফে জমে গিয়েছে। ভুলবশত আগের দিন বিকেলে বাইরে শুকাতে দিয়ে জুতাজোড়া ভিতরে আনতে ভুলে গিয়েছিলেন। সারা রাতের তুষার-বরফে লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে পর্বতারোহণের জুতা। চিন্তায় পড়লেন তিনি, ‘তা হলে কি আজ আর এগোনো হবে না?’
এবারও অদম্য রইলেই এই অভিযাত্রীদল। প্রায় দু’তিন ঘণ্টার চেষ্টায় অবশেষে ভিজা জুতায় পা গলানো গেল। এরপর বাকিটা ইতিহাস। সামনে এগিয়ে চলার ইতিবৃত্ত।
১৯৫৩ সালের ২৯ মে। সকাল সাড়ে এগারোটা। প্রমবারের মত এভারেস্ট চুড়ো স্পর্শ করলেন দুই অভিযাত্রী: স্যার এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগে।
প্রথমে শীর্ষভূমিতে পা রাখলেন এডমন্ড হিলারি। ঠিক তার পেছনেই তেনজিং নোরগে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টে এই প্রথম মানুষের পদচিহ্ন অঙ্কিত হলো। ২৯ মে, ১৯৫৩।
অর্ধ-শতাব্দীরও বেশি সময়ে পৃথিবী বদলেছে অনেক। বদলেছে পর্বতাভিযানের নিয়ম-কানুনও। সাজ-সরঞ্জামও অনেক আরামদায়ক ও সুলভ হয়েছে। অথচ প্রথম বিজয়ের দিনগুলো ছিল অনেক বিরূপ। আত্মজীবনীতে সেসব কথা বলে গেছেন তেনজিং।
শিখর জয়ের জন্য সেদিন ২৭,৯০০ ফুট উচ্চতায় ৯ নম্বর শিবির থেকে ভোর সাড়ে ছ’টায় রওনা হয়েছিলেন হিলারি-তেনজিং জুটি। এখন তিন-চারটে শিবির যথেষ্ট। দিনে নয়, অ্যাডভান্সড ক্যাম্প থেকে সন্ধ্যায় বের হয়ে পরদিন সকালে শিখর ছোঁয়াই নিয়ম।
তেনজিংদের জয়ের খবর দুনিয়াকে জানাতে নিকটবর্তী নামচে বাজারের পোস্ট অফিসে টেলিগ্রাম করতে ছুটেছিল রানার। দিনে দিনে এতো বড় বিজয়ের খবর পায়নি পৃথিবীর মানুষ।
আর এখন? স্যাটেলাইট ফোনে এভারেস্ট-শীর্ষ থেকেই কথা বলা যায়।
কিছু ইতিহাস কিন্তু অটুট। যেমন খুম্বু অঞ্চলের হতদরিদ্র শেরপা সম্প্রদায়, যেখান থেকে তেনজিং উঠে এসেছিলেন। তাদের ভাষায় লিখিত বর্ণমালা নেই, পাহাড়ে মালপত্র বয়ে আর ইয়াক চরিয়ে জীবন কাটাতে হয় তাদের। বিংশ শতাব্দীতে তেনজিং-ই প্রথম এশিয়া থেকে উঠে-আসা নিম্নবর্গের নায়ক। তাঁর আগে কোন এশীয় বীর এত নিচু স্তর থেকে উঠে আসেননি।
সেই তেনজিং আরেকটি কাজ করলেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শীর্ষে পৃথিবীর মানুষের বিজয় পতাকা উত্তোলন করে দু’জনে শিখরে কাটালেন মিনিট পনেরো। আবেগপ্রবণ তেনজিং বহু ব্যর্থতার পর বিজয় পেয়ে নিজের জীবনের এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন।
তেনজিং শৈশব থেকে নিজের জন্মের তারিখটা পর্যন্ত সঠিক জানতেন না। যে পশ্চাৎপদ সমাজে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন, সেখানে লেখালেখি বা ইতিহাস রক্ষার কোনও রেওয়াজই ছিল না। এভারেস্ট জয়ের পর ২৯ মে তারিখটাকেই তিনি জন্মদিন হিসেবে গ্রহণ করতেন।
এই অভিযানের পর সত্যিই তো এক নতুন তেনজিংয়ের জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর বুকে। তাকেই বোধহয় মনে মনে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তেনজিং। এভারেস্ট বিজয়কে নিজের জীবনের অংশ করে রেখেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন: ১৬ বার ব্যর্থ হয়েছিলেন তেনজিং!
আরও পড়ুন: ইভেন-বরিলিয়ান আউট, হিলারি-তেনজিং ইন