মিডিয়ায় প্রকৃতির বিরূপ আচরণের খবর আসছে। ঘোরতর বর্ষাতেও বৃষ্টির দেখা নেই। উত্তর জনপদে আষাঢ়েও খটখটে জমি। নদীতে পানি নেই। বৃষ্টিহীন বর্ষায় অতিক্রান্ত হচ্ছে অতীতের স্মৃতিময় জল ছলছল মৌসুম।
আবহাওয়া যে বদলে যাচ্ছে, তেমন আঁচ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বর্ষায় বৃষ্টি যেমন নেই, তেমনি শীতেরও প্রকৃত আভাস পাওয়া যায় না। একদা ষড়ঋতুর বাংলাদেশে বিভিন্ন ঋতুর বর্ণিল আমেজে উৎসবমুখরতায় প্রকৃতিকে উপভোগ করেছে মানুষ। মানুষের জীবনে বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গে ঋতুবৈচিত্র্যের যথেষ্ট যোগ ছিল। কিন্তু সেই বৈচিত্র্য যেন কোথাও ভাটা পড়েছে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্ব জুড়েই বেশ কয়েকটি বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জোরালো আলোচনা হচ্ছে। কয়েক বছর আগেই সমুদ্রস্রোতের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে-সৃষ্ট ‘এল নিনো’র ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুর বিচিত্র পরিবর্তন সকলকেই ভাবিয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা দেখেছেন অসময়ের প্রবল বৃষ্টি, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, প্রবল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, প্রচণ্ড শুষ্কতা, দাবদাহ, শীতের ওঠা-নামা স্বাভাবিক হিসাবের বাইরে চলে যাচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ুর এই বিচিত্র ব্যবহারের কার্য-কারণ খোঁজার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি প্যানেলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। দীর্ঘ গবেষণার পর সেই প্যানেল একবাক্যে জানিয়েছে, এ পরিবর্তন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে হচ্ছে না। শিল্পবিপ্লব ও অতি যান্ত্রিকীকরণের ফলে উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। আর এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাগত ভারসাম্য। তাই ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর আবহাওয়া, পরিবেশ ও প্রকৃতি সবসময় একই রকম থাকবে, এমনটি ভাবা উচিত নয়। এ বিশ্ব জগতের কোনো কিছুই স্থির নয়। বরং ধীর লয়ে হলেও পরিবর্তনশীল। আমরা টের পাচ্ছি না বটে, তথাপি আমাদের আবাসস্থলও পরিবর্তনের মাঝ দিয়েই চলছে। এই পরিবর্তন কতক প্রাকৃতিক আর কতক আমাদের ভুলের ফলে সৃষ্ট।
বিজ্ঞানীরা এটাও জানিয়েছেন, আজ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবী ছিল গ্যাসের পিণ্ড। ক্রমে ক্রমে সূর্যের অন্যতম গ্রহ পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ। এই পরিবেশকে যত দীর্ঘসময় আঘাত-না-করে ধরে রাখা যায় ততদিনই প্রাণের অস্তিত্ব, মানুষের জীবনযাপন, সভ্যতার পথচলা ইত্যাদি জীবনমুখী কার্যক্রম ভারসাম্যপূর্ণভাবে সম্ভবপর হবে। আবহাওয়া থাকবে সুনিয়ন্ত্রিত। জলবায়ু ও পরিবেশ হবে সহনীয়। সামগ্রিক জীবনধারাই উপকারী প্রকৃতির সঙ্গে সুসমন্বিত হয়ে ছন্দোবদ্ধভাবে চলবে।
কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতি ও পরিবেশের নানামুখী ক্ষতি করার ফলে বিরূপ আবহাওয়াগত পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে মানুষ ও সমাজ। উন্নত ও অনুন্নত, উভয় দেশেই কমবেশি মাত্রায় প্রকৃতি ও পরিবেশ হননের কাজটি হচ্ছে এবং পৃথিবীর সকল দেশের মানুষই সেই ক্ষতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। রাজনৈতিক সীমারেখা দিয়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। নগরে আগুন লাগলে যেমন আলাদাভাবে দেবালয় রক্ষা করা যায় না, তেমনি বিশেষ কোনো দেশ সে বিপর্যয় থেকে বেঁচে থাকতে পারছে না। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর গোলার্ধের অতি উন্নত দেশগুলোকেও প্রাকৃতিক তাণ্ডবে হিমশিম খেতে দেখা গেছে। শীতপ্রধান দেশেও বাড়ছে উষ্ণতা।
আবহাওয়া নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের চিন্তা অনেক বেশি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো ব-দ্বীপ অঞ্চল, যারা পাহাড় ও সমুদ্রের সন্নিকটবর্তী, তাদের ভাবনার মাত্রাটি আরো গভীর। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাহাড়ের বরফ গলে কিংবা সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে এই তটবর্তী দেশগুলোকে নানাভাবে বিপযস্ত করবে। কিছু কিছু কুপ্রভাব তো এখনই দেখা যাচ্ছে। গ্রীষ্মের দাবদাহ চরম ও প্রলম্বিত হচ্ছে। নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের বাংলাদেশের গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা ঋতুর নির্ধারিত সীমানা মানছে না। বর্ষায় বৃষ্টি না হলেও শরতে-হেমন্তে, এমনকি, নিকট-অতীতে শীতের কয়েকটি দিনেও বৃষ্টিপাতের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শরতের নির্মল ছোঁয়া আর হেমন্তের মিষ্টি পরশ বলতে গেলে বিলীন। গরম আর বর্ষা দখল করেছে শরৎ আর হেমন্তকে। শীত অস্বাভাবিকত্ব দেখাচ্ছে। বসন্তের পেলবতাও চরম আবহাওয়ার কাছে লীন। বাংলাদেশ এখন ষড়ঋতুর বদলে শীত আর গরম, এই দুই ঋতুর দেশে পরিণত হতে চলেছে।
জলবায়ু ও প্রকৃতির বিরূপতায় সৃষ্ট পরিবর্তমান পরিস্থিতি ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে আমাদের জীবনচক্রে। আবহাওয়ার চিরায়ত ধারা মনে হয় হারিয়ে গিয়ে নতুন একটি ঋতুগত কাঠামো আমাদেরকে আচ্ছন্ন করছে। জীবনের নান্দনিক প্রভায় ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে উপভোগের দিন যেন অপসৃয়মাণ। প্রতিটি ঋতুতেই লেগেছে অদল-বদলের মাতাল হাওয়া। জীবনে ও সাহিত্যে চিরচেনা ঋতুগত কালগুলোকে আর আদি ও অকৃত্রিমভাবে নিটোল আকারে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত, সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বর্ষায় যেমন বৃষ্টিহীনতা দেখছি, তেমনি বিগত শীতে দেখতে পাওয়া গেছে অন্যরকম। শীতকে রোমান্টিক কুয়াশাবৃত আমেজে উপভোগের মনে হয়নি। মনে হয়েছিল ইউরোপের নির্মম বাতাসের পদধ্বনিতে সাইবেরিয়ার আবাহন। কবিতায় লেখা শীত বা অন্যান্য ঋতুর চিত্রকল্প মনে হয়, ইতিহাসের অংশ হয়ে জীবনের বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণভাবে যাবে!
প্রকৃতি, পরিবেশ, ঋতু নিয়ে রচিত কবিতাগুলোকেও মনে হচ্ছে রূপকথার মতো। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ছিল, ‘আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়’, সেই কবিতার পথ ধরে পৌষের সন্ধ্যায় এখন আর হাঁটা সম্ভব নয়। তীব্র শীতের সন্ধ্যা ও রাতগুলো ঘরের ভেতরের উষ্ণতায় থাকতেই মন চায়। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আরো তীব্র শীত আসবে সামনের বছরগুলোতে। গ্রীষ্মে যেমন আসবে উষ্ণতা ও দাবদাহ।
আমরা মনে হয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের এক চরম পালাবদলের মধ্যে দিয়ে বিরূপ আবহাওয়া পেরিয়ে সামনের এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছি!