সভ্যতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে জর্জ স্টিফেনসনের নাম। ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই তার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ১৮২৫ সালে যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম চালু হয় পাবলিক রেল যোগাযোগ। স্টকটন থেকে ডার্লিংটন পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ধাতব রেললাইন তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থার বাজারে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়। স্টিফেনসনের এই আবিষ্কার ইংল্যান্ডের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে আমেরিকা ও জার্মানিতে। তারপর ইতালি, ফ্রান্স ও সুইডেনেও জনপ্রিয়তা পায় রেল যোগাযোগ।
মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকা ও জার্মানীর মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনে ব্রিটিশ শাসিত বাংলাও পিছিয়ে ছিল না। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ঔপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের জন্য যুক্তরাজ্যে প্রাথমিকভাবে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা হতে থাকে। এরূপ পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাদিসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা। ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডালহৌসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক পর্ষদের কাছে ভারতবর্ষে রেলওয়ে স্থাপন কাজ শুরু করার জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব পাঠান।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৪৪ সালে আর.এম স্টিফেনসন কলকাতার কাছাকাছি হাওড়া থেকে পশ্চিম বাংলার কয়লাখনি সমৃদ্ধ রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এর পুরোটাই ছিল উপমহাদেশের মাটিতে ব্রিটিশ শাসনকে মজবুত করার একটি নতুন পদক্ষেপ।
ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করার পরেও প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে ও সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে ১৮৫০ সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুয়েলার রেলওয়ে নামক কোম্পানি মুম্বাই থেকে থানা পর্যন্ত ৩৩ কিমি দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করতে থাকে। লাইনটি উদ্বোধন করা হয় ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩ সালে। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিমি রেললাইনের উদ্বোধন হয় ১৮৫৪ সালে এবং এর মাধ্যমে চালু হয় বাংলার প্রথম রেললাইন।
বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ব্রিটিশ আমলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৮৫২ সালে কর্নেল জে.পি কেনেডি গঙ্গা নদীর পূর্বতীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু এর মধ্যেই ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার বার্মা দখল করে। বার্মাকে সরাসরি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণেই কলকাতা ও বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের প্রশ্নটি প্রকট হয়। ফলে বাংলাদেশে রেললাইন বসানোর আগেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে বার্মাকে যুক্ত করতে নির্মিত হয় রেঙ্গুন-কলকাতা রেলরুট।
তারপর ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে। পরবর্তীতে এই লাইনকেই বর্ধিত করে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর বর্তমান চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিমি ব্রডগেজ রেললাইন শাখা উন্মোচন করা হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম রেললাইন।
সে সময় কুষ্টিয়া ছিল প্রান্তিক স্টেশন, কিন্তু ১৮৬৭ সালে পদ্মা ভাঙনের কারণে তা স্থানান্তরিত হয় গড়াই নদীর পাড়ে এবং পরবর্তী বছরে আদি কুষ্টিয়া স্টেশন পরিত্যক্ত হয়। কুষ্টিয়া থেকে পদ্মার পাড়ে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিমি দীর্ঘ রেললাইন উদ্বোধন করা হয় ১ জানুয়ারি ১৮৭১ সালে।
ইতিহাসমতে, বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেলওয়ে স্টেশন হলো কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশন। অথচ এই ঐতিহাসিক স্টেশনে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি কখনো। সংস্কার না থাকায় পুরাতন বিল্ডিংগুলো ধসে পড়েছে। সরকারি জায়গাগুলোও বেহাত হয়ে গেছে। ১৮৬২ সালে স্থাপিত হবার পর জগতি এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও ওঠা-নামার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। স্টেশনটি ইঞ্জিনের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। দুই পাশে দুটি বড় ইঁদারা আর দিঘি আজও রয়ে গেছে। লোকজনের ভিড় সামাল দিতে একসময় সেখানে ২৬ জন রেলওয়ে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। এখন সেখানে মাত্র ৩ জন রয়েছে। লোকবলের অভাবে এখন স্টেশনের কার্যক্রমও ভেঙে পড়েছে। সংস্কারের অভাবে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে। যাত্রীরাও সুযোগ সুবিধার অভাবে জগতিমুখী হচ্ছে না।
এদিকে যাতায়াতের জন্য রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশন।