গুজব মন্ত্রী গোয়েবলস

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 20:12:31

গুজব শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে নানা কারণে নানা প্রকারের গুজব ছড়ানো হয়েছে। আর এসব কিছুই ব্যবহার করা হয়েছে কোনো বিশেষ দলের বা মহলের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কখনো কাউকে চাঁদে দেখতে যাওয়ার গুজব আবার কারো মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে একটা মহল তার স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে সবসময়। আবার কখনো সত্য ঘটনাকে গুজব বলে গুজব ছড়িয়েছে কেউ কেউ। কিন্তু এই গুজব ছড়ানোতে যেই ব্যক্তি সবচেয়ে ওস্তাদ ছিলেন তার নাম গোয়েবলস। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হয়ে নানা প্রকার গুজব ছড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন।

‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যা’ কিংবা ‘এটি গোয়েবলসীয় মিথ্যাকেও হার মানাবে’—এমন একটা কথা আমরা প্রায়ই লোকমুখে বা বই পুস্তকে শুনে থাকি। প্রশ্ন আসতে পারে কে এই গোয়েবলস? অবাক হলেও সত্যি তিনি ছিলেন একজন “গুজব পরিচালনা” মন্ত্রী। আর তাকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘাতক এডলফ হিটলার। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন “মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা” নামে একটি আলাদা বিভাগ তৈরি করেন হিটলার। আর এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকে গোয়েবলসের ওপর।

পল জোসেফ গোবলসের জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৮৯৭ সালে জার্মানির রিদত শহরে। ১৯২১ সালে তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেন। এছাড়া ব্যাংকের করণিক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি একজন লেখক হতে চাইতেন। তার লেখার হাতও ছিল চমৎকার। যে কোনো সধারণ বিষয়কে মাখন লাগিয়ে খুবই সুস্বাদু করে উপস্থাপন করতে পারতেন। রস, রঙহীন যে কোনো বিষয়কে তিনি তার দক্ষতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে রাঙিয়ে দিতে পারতেন। উপন্যাস এবং বেশ কয়েকটি নাটকও রচনা করেছিলেন তিনি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Jul/16/1563264828462.jpg
সন্তানদের সঙ্গে গোয়েবলস ◢

 

প্রোপাগান্ডা বা গুজব শব্দটি শুরুতে একটি ইতিবাচক শব্দ ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে তাদের সেনা এবং জনগণের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রেষণা যোগানোর জন্যে এর ব্যবহার শুরু করে। এডলফ হিটলারও বুঝতে পেরেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের এমন পরাজয়ের কারণ আর কিছু নয় বরং ব্রিটিশদের এমন গুজব ছড়ানো। তাই হিটলার আলাদা মন্ত্রণালয় খোলেন এই প্রোপাগান্ডা রুখতে। নাম দেন “মিনিস্ট্রি অব পাবলিক এনলাইটেনমেন্ট এন্ড প্রোপাগান্ডা”। আর এর প্রধান করেন তার সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী “দ্য লিটল ডক্টর” নামে পরিচিত গোয়েবলসকে, যিনি প্রোপাগান্ডা শব্দটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। আর তাই এখনো পৃথিবীজুড়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক জনপ্রিয় “গোয়েবলসীয় কায়দা”।

তিলকে তাল বানানোতে ওস্তাদ এই ব্যক্তি ছোটবেলা থেকেই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। তার ডান পা ছিল বাম পা অপেক্ষা মোটা এবং ছোট। আর এই শারীরিক অক্ষমতার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু তিনি সেই দুর্বলতা দূর করেছিলেন তার তুখোড় ভাষণ ও লেখনী শক্তি দ্বারা।

১৯২২ সালে অ্যাডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনেই তার জীবনের ধারা পাল্টে যায়। যোগ দেন হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে (নাৎসি পার্টি)। যোগদান করেই শুরু করেন তার ম্যাজিক দেখানো। যা কস্মিনকালেও ঘটার সম্ভাবনা নেই, এমন ঘটনা ঘটেছে রব তুলতে তার জুড়ি ছিল না। বাচনশৈলি ও অন্যান্য যোগ্যতা দিয়ে সামান্য একটা বিষয়কে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলতেন তিনি। আর তা করতেন অত্যন্ত গোপনভাবে। বিষয়গুলো এতই গোপন থাকত যে তার একান্ত সচিবও এসব জানতেন না। গোয়েবলসের সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা ব্রুনহিল্ড পমসেল এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি জানি, এখন আমাদের আর কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই মনে করে আমরা সব গুজবের ব্যাপারে জানতাম। আসলে তা না। আমরা কিছুই জানতাম না। সবকিছুই আমাদের থেকে গোপন রাখা হতো।

এখনকার এই ইন্টারনেটের যুগে গুজব ছড়ানো কোনো কঠিন বিষয় না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মুহূর্তেই তিলকে তাল বানিয়ে পৌঁছে দেওয়া যায় হাজার হাজার মানুষের কাছে। কিন্তু তখন এত সহজ ছিল না। তাই হিটলার আর গোয়েবলস মিলে আঁটলেন এক বিশাল ফন্দি। তারা সবাইকে বিনামূল্যে রেডিও উপহার দিতে শুরু করেন। আর তার পরেই শুরু হয় আসল খেলা। রেডিওতে গুজবের বেসাতি ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দেওয়া আর স্বজাতির মনে সরকারের আনুগত্য সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে নিত্য নতুন গল্প বানাতে থাকেন তিনি। এভাবেই ক্রমান্বয়ে হিটলারের একজন বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত হন।

ফ্রি রেডিও বিতরণ ◢

 

হিটলার ছিলেন প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে গিয়ে তখনকার পরাশক্তি ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের কাছে এই মর্মে নাকে খত দিয়েছে যে তারা আর যুদ্ধ করবে না। এখন থেকে শান্তির পথে চলবে তারা। এই অপমান সইতে পারেননি হিটলার। হিটলার এবং গোয়েবলস দুজনেই বিশ্বাস করতেন, ভালো এবং সময়োপযোগী একটি স্ক্রিপ্ট এবং একটি দৃষ্টিনন্দন ছবি যে কোনো আদর্শ প্রচারের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কেননা ব্রিটিশরা এই অস্ত্র ব্যবহার করেই হারিয়ে দিয়েছিল জারমানদের। মূলত এ কারণেই, প্রোপাগান্ডাকে তারা প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন। গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন, শুধুমাত্র হিটলারের মেধাবী এবং অতুলনীয় নেতৃত্বের মাধ্যমেই জার্মানির হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাওয়া সম্ভব।

গোয়েবলস তার লেখাগুলো জনসম্মুখে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নানা রকম উপায় ব্যবহার করতেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো বিশাল জনসমাবেশ করা। তার অসাধারণ লেখনিগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেই বিশাল সমাবেশের আয়োজনও করা হতো বিশালভাবে। নানা রকম আতশবাজি, প্যারেড, জাতীয় সঙ্গীতের সাথে থাকত ব্যাপক আলোকসজ্জা, আর বাহারি রঙের পোস্টার। ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন এমন জায়গায় স্থাপন করা হতো যাতে হিটলার এবং তার ভাষণ দেশের প্রতিটা মানুষের কানে পৌঁছে যেতে পারে।

নাৎসি পার্টির বিশাল সমাবেশের একটি চিত্র ◢

 

তার সবচেয়ে বড় প্রপাগান্ডা ছিল হিটলারকে সকল জার্মানবাসীদের কাছে একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে পৌঁছে দেওয়া। আর তাই তিনি হিটলারের নামে এমন সব স্তুতি গাইতেন যেগুলো শুনতে সত্যের মতোই মনে হতো। গুয়েবলসের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, “আপনি যদি একটি বিশাল মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন, তাহলে মানুষজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।” আর তাই তিনি বারবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাবেশে হিটলার এবং জার্মান বাহিনীকে নিয়ে নানা মিথ্যা গুজব ছড়াতেন যেগুলাতে হিটলারকে একজন কিংবদন্তি এবং জার্মান বাহিনীকে যুদ্ধে অবশ্যই বিজয়ী বলে মনে হতো সকলের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলার প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদি নিধন করেন। যেটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। সেই ইহুদি হত্যার জন্য কিন্তু জার্মানরা হিটলারকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তার পেছনেও ছিল এই গোয়েবসের প্রপাগান্ডা। ১৯২৪ সালের ৪ জুলাই তিনি লেখেন, “জার্মানিতে এখন একজন শক্ত মানুষের দরকার। জার্মানিকে নিয়ে সব রকমের নিন্দা আর অন্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ হওয়া দরকার। আমাদের এখন সর্বস্ব উজাড় করে কাজ শুরু করতে হবে। এই ইহুদিদের আমরা চাই না। কারণ তারা কখনো সত্যিকার জার্মান নয়। ওদের কঠিন শাস্তি দেওয়া দরকার। এরা কেবল সমস্যাই তৈরি করছেন।” তিনি হিটলারের গুণগান গেয়ে বলেন, “দারুণ খরায় পৃথিবী যেমন হাহাকার করে বৃষ্টির জন্য, তেমনি জার্মানিও এখন এমন এক মানুষের জন্য হাহাকার করছে যে তাদেরকে এই দৈন্যদশা থেকে উদ্ধার করবে। আর তিনি অন্য কেউ নন, তিনি আমাদের মহামতি স্যার এডলফ হিটলার।” এরপরেই মেরে ফেলা হয় লাখো ইহুদিকে, বিনা প্রশ্নে, বিনা বাধায়।

গোয়েবলস এবং তার পরিবার ◢

 

তার এসব প্রপাগান্ডার ফলে জার্মানরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে একমাত্র হিটলার পারেন জার্মানের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু গোয়েবলস জানতেন, তারা যদি পরাজিত হন তবে বিশ্ববাসী তাদের আর কখনো এমন চোখে দেখবে না। তাই তিনি বলেন, “আমরা ইতিহাসে ঠাঁই পাব হয় সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র অধিনায়ক অথবা সর্বশ্রেষ্ঠ অপরাধী হিসেবে।”

হিটলারকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসতেন তিনি। “সত্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু” বিবেচনা করা এই লোক মারা যান হিটলারের মৃত্যুর ঠিক পরের দিন। পরাজয় নিশ্চিত জেনে অবশেষে ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে হিটলার সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। ঠিক তার পরের দিনই ১ মে গোয়েবলস তার মেয়ের জন্মদিনে প্রথমে তার ছয় সন্তান এবং স্ত্রীকে হত্যা করেন। পরে নিজেও তার প্রিয় নেতা হিটলারের পন্থা অবলম্বন করে আত্মহত্যা করেন।

গোয়েবলস সম্পর্কে তার সচিব পমসেল বলেন, দেখতে খাটো এই লোকটি ছিলেন প্রচুর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। দামি কাপড়ের স্যুট পরতেন, নখের যত্ন নিতেন, ভাষায় ছিলেন খুবই মার্জিত এবং পরিমিত। কে জানত এমন গোছালো একটা ভালো মানুষের আড়ালে এমন একজন ভয়ানক ব্যক্তি ঘাপটি মেরে বসে আছে!

এ সম্পর্কিত আরও খবর