জানুয়ারি কিভাবে বছর আরম্ভের মাস হলো

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-28 00:01:55

বেশিরভাগ দেশেই বছরের শুরুটা হয় জানুয়ারির প্রথম দিন। কেউ কেউ অবশ্য ২৫ মার্চ বা ২৫ ডিসেম্বরের মতো অন্যদিনকে গ্রহণ করেছে। তবু জানুয়ারির ১ তারিখের দাবি যেন অন্যরকম। এক অদ্ভুত দ্যোতনা নিয়ে একযোগে পালন করা হয় দিনটাকে। কিন্তু কিভাবে জানুয়ারি হয়ে উঠল বছর আরম্ভের মাস? সেই গল্পই থাকছে আজকের আয়োজনে—

১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন করার ইতিহাস বেশ পুরনো। কিছুটা কৃতিত্ব রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াসকে দেওয়া যেতে পারে। রোমের দ্বিতীয় সম্রাট ছিলেন তিনি। শাসনকাল ৭১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। রোমের বেশিরভাগ রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তার হাতেই সৃষ্ট। সিংহাসনে আরোহনের পর নুমা আগের রোমান পঞ্জিকা পর্যবেক্ষণ করেন। তখন মার্চ মাসকে গণ্য করা হতো বছরের প্রথম মাস হিসাবে। নুমা জানুয়ারিকে প্রথম মাসের আসন দান করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্তটা বুদ্ধিবৃত্তিক বা যুক্তি বিচারে না, পছন্দ আর অপছন্দের ওপর ভর করে জন্ম নিয়েছে। জানুয়ারি মাসের নাম এসেছে রোমান জানুস-এর নাম থেকে। জানুস ছিলেন সকল কিছুর আরম্ভের দেবতা। মার্চ নামের উৎপত্তি মার্স থেকে। রোমান যুদ্ধ দেবতার নাম। শুরুর দেবতাকে শুরুতে না রেখে যুদ্ধের দেবতাকে রাখা হলে কি ভালো দেখায়?

নুমা পম্পিলিয়াস ছিলেন রোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক ◢

 

অনেকে অবশ্য দাবি করতে চান, জানুয়ারি মাসটাই নুমার সৃষ্টি। সে যা-ই হোক, ১৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে সরকারিভাবে ১ জানুয়ারিকে বছরের আরম্ভ বলে গণ্য করা হয়নি। তারও এক শতাব্দী পরে ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার নতুন করে সংস্কার আনলেন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারির প্রথম দিনকে বছরের প্রথম দিন বলে মর্যাদা দেওয়া হলো। পূর্বে বাইজ্যান্টাইন সম্রাট কনস্টানটাইনের ধর্মান্তরের মধ্য দিয়ে খ্রিস্ট ধর্ম ব্যাপক পৃষ্টপোষকতা লাভ করে। বাড়তে থাকে রোমান সাম্রাজ্যের পরিসর। সেই সাথে ক্যালেন্ডারের ব্যবহারও ছড়িয়ে পড়ল সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ৪৭৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে উত্তর ইউরোপের বার্বারদের কাছে। আপাতভাবে কেন্দ্রবিচ্ছিন্ন খ্রিস্টান অঞ্চলগুলো ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনে এবার। নতুন নববর্ষের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় মার্চের ২৫ তারিখ (ঘোষণা উৎসবের দিন) এবং ডিসেম্বরের ২৫ তারিখ (ক্রিসমাস)।

রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত জুলিয়ান পঞ্জিকার তাৎপর্য ছিল ব্যাপক ◢

 

পরবর্তীকালে জুলিয়ান পঞ্জিকায় আরো পরিবর্তন আসে। লিপ ইয়ার নির্ণয়ে ঘটে রদবদল। হিসাবে ভুল হবার দরুণ পরের কয়েক শতক ভুল সময়ে পালিত হয়েছে অনেক উৎসব। তারচেয়ে বড় কথা, ‘ইস্টার’-এর তারিখ নির্ধারণে সমস্যা দেখা দেয়। মধ্যযুগের নানা ঘটনায় আমূল বদলে যায় ইউরোপ। বিশেষ করে ক্রুসেড এবং ব্ল্যাক ডেথ-এর ঝড়। সেই সাথে ছিল চার্চের দুর্নীতি এবং সামন্ততন্ত্রের শোষণ। দীর্ঘদিন পর পোপ অষ্টম গ্রেগরি পঞ্জিকার দুরবস্থা উপলব্ধি করে সংস্কার সাধন করেন ১৫৮২ সালে। সেই সাথে সমাধান করেন লিপ ইয়ারের সমস্যাও। এই পঞ্জিকা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে ইতিহাসে পরিচিতি লাভ করে।

গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় জানুয়ারির প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসাবে স্থান দেওয়া হয়। ইতালি, ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো প্রভাবশালী দেশগুলো দ্রুত এই নতুন পঞ্জিকাকে গ্রহণ করে। ফলাফল ছিল সদূরপ্রসারী। প্রোটেস্ট্যান্ট কিংবা অর্থোডক্স সমাজ এক্ষেত্রে বেশ মন্থর। নতুন পঞ্জিকার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে লেগেছে বহুদিন। ব্রিটেন এবং তার আমেরিকান উপনিবেশগুলো ১৭৫২ সালের আগে গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাকে অনুসরণ করেনি। তার আগে পর্যন্ত নববর্ষ পালিত হতো ২৫ মার্চ।

সময়ের সাথে সাথে অখ্রিস্টান দেশসমূহও গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা ব্যবহার শুরু করে। অবশ্য ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন কিংবা পর্তুগালের উপনিবেশের দৌরাত্মকেও বিস্তৃতির পেছনে দায় কিছুটা দেওয়া যায়। তার মধ্যে বড় উদাহরণ চীন। চীনে এই পঞ্জিকার প্রচলন ঘটে ১৯১২ সালে। যদিও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুসারেই চান্দ্রমাস হিসাবে নববর্ষ পালিত হতো। প্রকৃতপক্ষে অনেক দেশ গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা গ্রহণ করলেও তাদের স্থানীয় এবং ধর্মীয় নিজস্ব ক্যালেন্ডার আছে। এমন দেশও আছে, যারা কখনোই গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা গ্রহণ করেনি। সুতরাং জানুয়ারিতে না হয়ে নববর্ষ অন্যদিন হয়। ইথিওপিয়াকে এইখানে উদাহরণ হিসাবে আনা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে ‘এনকুতাতাশ’ নামে পরিচিত তাদের নববর্ষ পালিত হয় সেপ্টেম্বরে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর