ফ্লপ মাস্টার দুর্গাদাস থেকে মহানায়ক উত্তম কুমার

, ফিচার

মরিয়ম সুলতানা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:17:14

আজ থেকে ৩৮ বছর আগে—মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই আপামর বাঙালিকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান মহানায়ক উত্তম কুমার। ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর, কলকাতার ৫১ নম্বর আহিরীটোলায় নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম।

তখন ভরদুপুর। কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির পরিচারিকারা এসে তাকে বললেন, “দাদা মশাই, আপনার জন্য একটা খবর আছে। আপনার নাতি হয়েছে।” এই খবর শুনে তিনি বলে উঠলেন, “বেশ উত্তম খবর! নাতির নামও হবে উত্তম।” নানার দেওয়া সেই নামের মর্যাদা রাখতেই যেন পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠলেন এক এবং অদ্বিতীয় উত্তম, বাঙালির মহানায়ক, রুপালি পর্দার গুরু।

উত্তম কুমার কলকাতার সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। তারপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার গোয়েংকা কলেজে। কিন্তু জীবন ও জীবিকার তাগিদে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা উত্তম গ্র্যাজুয়েশনটা আর শেষ করতে পারেননি। পড়াশোনা ছেড়ে কলকাতা পোর্টে কেরানি পদে চাকুরিতে যোগ দেন তিনি। এরই মাঝে আবার ১৯৪৮ সালে ভালোবেসে বিয়ে করেন গৌরী দেবীকে। এই সময়টাতে তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন। ধীরে ধীরে তাঁর ঝোঁক বাড়ে রুপালি পর্দার দিকে।

কিন্তু রুপালি পর্দায় নিজের জায়গা তৈরি করে নেওয়ার জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আজকের এই মহানায়ককে। তাঁর সর্বপ্রথম অভিনীত ছবি ‘মায়াডোর’। যদিও শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায়নি। তারপর তিনি সুযোগ পান নীতিন বোস পরিচালিত ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে, ১৯৪৮ সালে। এটিই ছিল উত্তম কুমার অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। এর পর ‘কার পাপে’সহ কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। তবে সেসব কোনো ছবিই ব্যবসাসফল হয়নি। ফলে একটা পর্যায়ে তার নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ফ্লপ মাস্টার’। তিনি সেটে ঢুকলেই লোকজন ঠাট্টা তামাশা করে রব তুলত, “এসেছে আমাদের নতুন দুর্গাদাস...”।

◤ উত্তম কুমার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবির পোস্টার◢

 

এভাবে একের পর এক ছবি ব্যর্থ হতে লাগলে তিনি হতাশ হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, আর চলচ্চিত্রে কাজ করবেন না, চাকরিতে মনোযোগ দেবেন। কিন্তু তখন তাঁর স্ত্রী গৌরী দেবী তাকে বলেন, তিনি যেন চলচ্চিত্র না, বরং চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলচ্চিত্রে মন দেন। কারণ তিনি ভালোভাবেই জানতেন অভিনয়টা উত্তম কুমারের রক্তে মিশে আছে। তারপর স্ত্রীর কথামতো তিনি চাকরি ছেড়ে এমপি স্টুডিওতে ৩ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন এবং ‘বসু পরিবার’ নামক সিনেমায় এক যৌথ পরিবারের আদর্শবাদী বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের দৃষ্টি কাড়েন। এ সিনেমায় সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন তাঁর ছোট বোনের ভূমিকায় এবং এটিই ছিল উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত প্রথম ছবি।

তারপর ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম কুমার প্রথমবারের মতো জুটিবদ্ধ হন নবাগতা অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। এই ছবিটিতে তারা রোমান্টিক জুটির ভূমিকায় থাকলেও এর মূল অভিনেতা ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী। ছবিটি ব্যবসাসফল হয় এবং এর সাথে সাথে চলচ্চিত্র জগতে উত্তম কুমারও পাকাপাকিভাবে একটা জায়গা গড়ে তোলার সুযোগ পান।

◤ উত্তম-সুচিত্রা জুটি ◢

 

এর ঠিক এক বছর পর, ১৯৫৪ সালে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প অবলম্বনে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে আবারও জুটি বাঁধেন উত্তম-সুচিত্রা, যা বিপুল পরিমাণ দর্শক জনপ্রিয়তা পায়। ওই সময়ে গুনে গুনে টানা ৬৫ সপ্তাহ ধরে হলে চলে ছবিটি। ছবিটি দারুণভাবে ব্যবসাসফল হওয়ায় উত্তম কুমারের আসন স্থায়ী হয়ে যায় চলচ্চিত্র জগতে। তারপর একের পর এক মুক্তি পায় উত্তম কুমার-সুচিত্রা সেন অভিনীত ব্যাপক সাড়া জাগানো ছবি ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘হারানো সুর’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘ইন্দ্রাণী’, ‘সূর্য তোরণ’, ‘সবার উপরে’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ইত্যাদি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁর জুটি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি হিসেবে এখনো পর্যন্ত বিবেচিত।

তবে উত্তম-সুচিত্রা জুটির মতো এত বেশি জনপ্রিয় না হলেও উত্তম-সুপ্রিয়া জুটিকেও দর্শক বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল। তাদের অভিনীত ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘লাল পাথর’, ‘শোন বরনারী’, ‘মন নিয়ে’, ‘শুধু একটি বছর’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ইত্যাদি ছবি দারুণ ব্যবসা সফল হয়েছিল।

◤ উত্তম-সুপ্রিয়া জুটি ◢

 

এদিকে, উত্তম-সাবিত্রী জুটিও পেয়েছিল বিপুল দর্শকপ্রিয়তা। বলা হয় যে উত্তম কুমারের বিপরীতে যারাই অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে সাবিত্রীর অভিনয়ই ছিল সবচেয়ে বেশি সাবলীল। সাবিত্রীর মাঝে বাহ্যিকভাবে প্রবল আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল না কিন্তু তার অভিনয়ে ছিল ঝরনা ধারার মতো সরলতা, স্বভাবিকতা। তাঁর এই নিপুণ অভিনয় শৈলির জন্য উত্তম-সাবিত্রী জুটি এত বেশি সমাদৃত হয়েছিল। এই জুটির বহু ছবি ব্যবসাসফল হয়। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নিশিপদ্ম’, ‘নবজন্ম’, ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’, ‘অভয়ের বিয়ে’, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘কলংকিত নায়ক’, ‘কুহক’, ‘দুই ভাই’, ‘ভ্রান্তি বিলাস’, ‘মোমের আলো’ ইত্যাদি।

◤ উত্তম-সাবিত্রী জুটি ◢

 

তবে রোমান্টিক ছবিতে অভিনয়ের পাশাপাশি অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম যা তাকে অভিনেতা হিসেবে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়। ফিরিঙ্গি কবি অ্যান্টনির কথা ধরা যাক। ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তম কুমার। এখানে একজন কবির জীবনের নিদারুণ কঠিন বাস্তবতাকে তার সুনিপুণ অভিনয় শৈলির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন উত্তম এবং এজন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পান।

এছাড়াও তিনি অভিনয় করেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের একজন, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ, সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে। অভিনয় করেন তাঁর ‘নায়ক’ এবং ব্যোমকেশ চরিত্রে ‘চিড়িয়াখানা’য়। সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ ছবিতেই বাংলার আরেক কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখা গেলেও, উত্তম কুমারের উপস্থিতি তাঁর ছবিতে বিরল। যদিও সত্যজিতের মাত্র দুটি ছবিতে অভিনয় করেছেন, দুটোর জন্যই পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

১৯৮০ সালে উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর সত্যজিৎ রায় তাঁর স্মৃতিচারণ করে লেখেন, “উত্তম কুমারকে প্রথম যখন স্ক্রিনে দেখি—তখনও আমি ডিরেক্টর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করিনি। অনেকের মুখে এই নতুন নায়কের কথা শুনেছি, এবং কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। টানা ৩টা সিনেমা দেখে ফেললাম উত্তম কুমারের। ৩টিই নির্মাণ করেছিলেন আমাদের সময়কার সেরা একজন নির্মাতা নির্মল দে। উত্তমের ব্যাপারে প্রথম ইম্প্রেশন ছিল—অসাধারণ! উত্তমের ছিল আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, চমৎকার লুক এবং সৌজন্যবোধ।”

উত্তম কুমার সম্বন্ধে সত্যজিৎ আরো বলেছেন, “উত্তমের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা—আমার ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। কাজ শুরুর প্রথমেই ধরে ফেললাম—অভিনয় ব্যাপারটা উত্তমের রক্তের সাথে মিশে আছে। সহজ ভাষায়—জাত অভিনেতা যাকে বলে। দুই শ্রেণীর অভিনেতার সাথেই কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে আমার। সেরিব্রেল অ্যাক্টরদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়া যায় বৈকি তবে সেক্ষেত্রে তাদের সাপোর্ট এবং মোটিভেশনের দরকার হয়। এরপর তারা চরিত্রে ঢুকে যায়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে—তাদের কাছ থেকে অভিনয়ের সারনির্যাস বের করে আনার ব্যাপারে কোনো গ্যারান্টি নেই। যেটা উত্তমের মতো ইন্সটিঙ্কটিভ অ্যাক্টরের বেলায় আছে। সঙ্গীতের প্রতিও ছিল তাঁর ভীষণ অনুরাগ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে এবং শ্যামল মিত্রের গানে ঠোঁট মেলাতেন উত্তম কুমার। গান রেকর্ডিংয়ের সময় শিল্পীর পাশে বসে তাঁর অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন তিনি। এতে করে অভিনয়ের সময় গানের সাথে ঠোঁট মেলানো তাঁর জন্য সহজ হতো।”

◤ উত্তম কুমার ও সত্যজিৎ রায় ◢

 

উত্তম কুমার সর্বমোট ২০২টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকবাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট ও ৫৭টি ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ ছবি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। বার্নার্ড শ’র নাটক ‘পিগম্যালিয়ন’ অবলম্বনে হলিউডের অড্রে হিপবার্ন অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘মাই ফেয়ার লেডি’র বাংলা রিমেক ছিল ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। এ ছবিতে তিনি কোথাও কোথাও ‘মাই ফেয়ার লেডি’র রেক্স হ্যারিসনকেও অতিক্রম করে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই ছবিতে ডাবিং সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি তিনি, তার আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। পরে তাঁর ছোটভাই তরুণ কুমার এ ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, তাঁর ভাই তরুণ কুমারও ছিলেন একজন নিয়মিত অভিনেতা। দুজনে বেশ কিছু ব্যবসাসফল ছবিতে একসাথে হাজিরও হয়েছিলেন পর্দায়।

◤ তরুণ কুমার ◢

 

উত্তম কুমার বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ধারা পাল্টে দেন। মঞ্চের সেই অতিরঞ্জিত অভিনয়ের ধারা পাল্টে তিনি সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় ধারার সূচনা করেন। বাস্তব জীবনে মানুষ যেভাবে হাঁটাচলা করে, কথাবার্তা বলে, চলাফেরা করে; উত্তম কুমার ক্যামেরার সামনে ঠিক তাই করতেন। সাবলীল অভিনয়, নায়কোচিত গ্ল্যামার, নজরকাড়া হাসিতে তিনি ছিলন স্বয়ংসম্পূর্ণ।

এদিকে, গৌরী দেবীকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও এক পর্যায়ে তাদের দাম্পত্য জীবনে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। ১৯৬৩ সালে উত্তম কুমার তার পরিবার ছেড়ে চলে যান। তারপর দীর্ঘ (১৯৬৩-১৯৮০) ১৭ বছর তিনি সেই সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করেন।

উত্তম কুমারের সম্মানার্থে কলকাতা মেট্রোর টালিগঞ্জ অঞ্চলের স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর