ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির যুগে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ

, ফিচার

সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-26 23:38:26

দ্বিতীয়ার্ধ্ব শেষে যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিট। ৪-৪ অ্যাগ্রিগ্রেটেড স্কোরলাইনের ম্যাচে অ্যাওয়ে গোলে পিছিয়ে থাকা ম্যানচেস্টার সিটির ত্রাণকর্তা হয়ে আবির্ভাব রাহিম স্টার্লিংয়ের। সার্জিও আগুয়েরোর মাপা পাস জালে জড়িয়েই ভোঁ-দৌড়ে পৌঁছালেন কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে। তবে ইউরোপ-সেরার লড়াইয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারল না তার দল। প্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিত করল আগুয়েরোর অফসাইড, তাতে শেষ চারে পা রাখল টটেনহাম হটস্পার।

গেল মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কোয়ার্টার ফাইনালে এই প্রযুক্তির বিতর্কিত প্রয়োগ দুই-দুইবার কপাল পুড়িয়েছে তারকায় ঠাসা ক্লাব ম্যানসিটির। বলা হচ্ছে বর্তমান সময়ের আলোচিত-সমালোচিত ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভিএআর নিয়ে—মাঠে রেফারিদের ভুল বা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এড়াতেই যার আবিষ্কার এবং ব্যবহার।

ন্যূনতম হস্তক্ষেপ, সর্বোচ্চ কল্যাণ’—এই মূলমন্ত্রে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ভিএআর-সংক্রান্ত চূড়ান্ত আইন পাশ হয় ২০১৮ সালে। গোল সিদ্ধান্ত, পেনাল্টি সিদ্ধান্ত, সরাসরি লাল কার্ড, ভুল খেলোয়াড়ের ওপর চাপানো সিদ্ধান্ত বদল—ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেবার মতো এই চারটি ঘটনা পুনর্বিবেচনায় সাহায্য নেওয়া হয় ভিএআরের। ভিডিও অপারেশন রুমে দক্ষ ও অভিজ্ঞ রেফারিদের সমন্বয়ে গড়া ভিএআর টিম মাঠে দায়িত্বরত রেফারির নেওয়া পুনর্বিবেচনাযোগ্য প্রতিটি সিদ্ধান্তই পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, আর তাতে কোনো ভুল শনাক্ত না হলে নিজের ইয়ারফোনে সেটি জানতে পারেন ম্যাচ রেফারি। এই ‘সাইলেন্ট চেক’ খেলা চলাকালীন সময়ের কোনো বিলম্ব ঘটায় না।

◤ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় ভিএআর টিমের সাথে যোগাযোগ করেন মূল রেফারি ◢

 

অন্যদিকে ভিএআর-এর হস্তক্ষেপে সময়ক্ষেপণ হয় তখনই, যখন মাঠের সিদ্ধান্তের যথার্থতা সরাসরি বিচারে ব্যর্থ হয় ভিএআর টিম। এসময় মূল রেফারি নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করে জানান দেন চলমান পর্যালোচনার বিষয়টি।

তবে অফসাইড সিদ্ধান্ত অথবা ডি-বক্সের ভেতরের/বাহিরের ফাউল সংক্রান্ত বিষয়গুলো যেমন ভিএআর দ্বারাই নিস্পত্তি সম্ভব, তেমনিভাবে একটি প্রাথমিক ফাউল কল বা লাল কার্ড প্রদর্শনের মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত রায়ের ভার বর্তায় মূল রেফারিরই ওপর। মোটকথা, সব অবস্থাতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানে ভিএআর টিমের পরামর্শ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখেন মূল রেফারি।

এই ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপে। প্রতিটি ম্যাচে, প্রতিটি ভেন্যুতে এই যুগান্তকারী পদ্ধতির পূর্ণ ব্যবহার দেখা যায়নি আগের কোনো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের সর্বমোট ৩৩৫টি ঘটনায় নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যবহৃত হয় ভিএআর, ম্যাচপ্রতি গড়ে যার দরকার পড়ে প্রায় ৭ বার। এরমধ্যে মূল রেফারির নেওয়া সিদ্ধান্তে বদল এসেছে মোট ১৪ বার।

◤ জার্মানি-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার ম্যাচে ভিএআর নিশ্চিত করে দক্ষিণ কোরিয়ার ২য় গোলটি ◢

 

তবে সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় কম তোলেনি ভিএআর। প্রযুক্তিগত নানা ক্রুটির পাশাপাশি ম্যাচের অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোয় এর যথাযথ ও দায়িত্বশীল ব্যবহার নিয়েও বেশ প্রশ্ন উঠেছে। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতে, স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতার অভাবই এখন পর্যন্ত ভিএআর-এর মূল দুর্বলতার জায়গা। প্রায় একই ধরনের ঘটনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভিন্নতা ভিএআর-এর ব্যবহারকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি স্বচ্ছতার অভাবও ভোগাচ্ছে দলগুলোকে। ভিএআর টিম ও মূল রেফারির মধ্যকার কথোপকথন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার মতো নানা সুপারিশ প্রত্যাখান করেছে ফিফা রেফারি কমিটি। এক ঝটকায় পুরো ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পেনাল্টি সিদ্ধান্ত কিংবা বারবার স্বাভাবিক ছন্দে বাধাসৃষ্টি ও সময়ক্ষেপণ ম্যাচের সৌন্দর্য ব্যহত করছে কিনা, তা নিয়েও সন্দিহান পণ্ডিত ও বোদ্ধারা।

ক্লাব পর্যায়ে দুই ইউরোপিয়ান টুর্নামেন্ট ও সর্বমোট আঠারটি ঘরোয়া লিগে আরো আগেই পা রেখেছে ভিএআর। প্রথমবারের মতো এই মৌসুমে আলোচিত প্রযুক্তিটির আগমন ঘটছে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লীগে। ‘গোললাইন টেকনোলোজি’র পর ভিএআরই হতে যাচ্ছে প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত সংযোজন। লিগের প্রধান কার্যনির্বাহী রিচার্ড মাস্টার্সের মতে, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও বিতর্কের সম্ভাবনা মেনে নিয়েই এর ব্যবহারে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত আছেন তারা। সময়ক্ষেপণের মাত্রা কমানোই এই মুহূর্তে মাস্টার্সের মূল লক্ষ্য। এরপরই প্রাধান্য পাচ্ছে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের বিষয়টি।

◤ স্টার্লিং-আগুয়েরোর বাঁধভাঙ্গা উদযাপন থামিয়ে দেওয়া সেই অফসাইড সিদ্ধান্ত ◢

 

সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণকালে মূল রেফারি ও ভিএআর টিমের কথোপকথন ও পদক্ষেপ প্রদর্শিত হবে মাঠের বড় পর্দায়। এক্ষেত্রে পর্দাহীন দুই ভেন্যু ওল্ড ট্রাফোর্ড এবং অ্যানফিল্ডে ব্যবহৃত হবে স্কোরবোর্ড ও পাবলিক অ্যানাউন্সমেন্ট (পিএ)। এছাড়াও সময়ক্ষেপণ ঠেকাতে পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ একটি মান নির্ধারণের নির্দেশ পেয়েছেন রেফারিরা, যাতে পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত তারা যেন ঘন ঘন পিচ-সাইড রিভিউ থেকে বিরত থাকেন এবং খেলার স্বাভাবিক ছন্দ বজায় রাখেন।

তবে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিএআর-এর স্বাভাবিক ব্যবহারে আসছে পরিবর্তন। অফসাইড পর্যবেক্ষণে প্রিমিয়ার লিগের টিভি রিপ্লে-তে এতদিন ব্যবহার হয়ে আসা থ্রি-ডি লাইনের সাহায্য এখন ভিএআর টিমও নিতে পারবে। এক্ষেত্রে ক্যামেরার সাহায্য নিয়েও নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না গেলে মাঠে দায়িত্বরত রেফারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

◤ এভারটনের গুডিসন পার্কের বড় পর্দায় ভিএআর বার্তা ◢

 

অন্যান্য টুর্নামেন্টগুলোয় সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দেওয়া পেনাল্টি সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা রাখছে প্রিমিয়ার লিগ। ফুটবলের নতুন রুলবুক অনুযায়ী পেনাল্টি কিকের সময় গোলরক্ষকের নিজ লাইনের বাইরে বিন্দুমাত্র নড়াচড়ায় পুনরায় পেনাল্টি কিক হবার বিধান থাকলেও প্রিমিয়ার লিগ বলছে, ‘চোখে পড়ার মতো’ নড়াচড়া ছাড়া একজন গোলরক্ষকের স্বাভাবিক পেনাল্টি সেভ তারা বাতিল করবে না।

শুধু মাঠের খেলোয়াড়েরাই নন, ভিএআর-এর ব্যবহারে দর্শকরাও প্রভাবিত হবেন ব্যাপকভাবে। স্পষ্টতই ভাটা পড়বে গোল-পরবর্তী বাঁধভাঙ্গা উদযাপনে, যেখানে পরোক্ষভাবে জায়গা নেবে ভিএআর রিভিউ-এ গোলটাই বাতিল হবার শঙ্কা। এছাড়া রেফারির প্রত্যক্ষ অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলোর পুনর্বিবেচনা বড়পর্দায় দেখা গেলেও গোল অনুমোদন/বাতিলের ক্ষেত্রে সেই পর্যালোচনা চলবে সমর্থকদের অজান্তেই।

এর পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ভিএআর চেকের আহ্বানে হলুদ কার্ড প্রাপ্তির বিধান থাকছে খেলোয়াড়-ম্যানেজার উভয়ের জন্য। রেফারির স্বাভাবিক যোগাযোগ কর্মকাণ্ড ও পর্যবেক্ষণ ব্যাহত করলে যা রূপ নিতে পারে লাল কার্ডের।

◤ দুই মৌসুম আগে এফএ কাপে নরউইচের বিপক্ষে বহিষ্কৃত হন চেলসির আলভারো মোরাতা ◢

 

এসব কিছু বিশ্লেষণে বলা যায়, ভিএআর-এর আগমনে এই মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগে মোট গোলসংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনাই জোরালো। তবে এর সদ্ব্যবহারে লিগ আসলেই প্রস্তুত কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান সাবেক ও বর্তমান নানা ফুটবল তারকা। ভিএআর-এর ব্যবহার ভুলক্রুটির পাল্লা আরো ভারী করবে বলেই মনে করছেন সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ইংল্যান্ড ফুলব্যাক পল পার্কার। চেলসি উইংব্যাক মার্কোস আলোনসোর কাছে যেমন বিভ্রান্তির আরেক নাম এই ভিএআর। একইভাবে বোর্নমাউথের ক্যালাম উইলসন মনে করেন, প্রিমিয়ার লিগের সবটুকু বিনোদনে জল ঢেলে দেবে এই প্রযুক্তি। পেপ গার্দিওলা, মাউরিসিও পচেত্তিনোরা ভিএআর নিয়ে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করলেও এর অন্তর্ভুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্যান্য অনেক কোচ। তবে ভিএআরকে খেলাটির স্বাভাবিক একটি অংশ হিসেবে মনে করতে হলে যে আরো অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের প্রয়োজন, সে কথা বলাই বাহুল্য।

এ সম্পর্কিত আরও খবর