ডেনভার এয়ারপোর্ট রহস্য ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আখড়া

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 15:13:19

পৃথিবীতে কিছু বিষয় আছে যেগুলোকে যুক্তি তর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করা মুশকিল। আমেরিকার ডেনভার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তেমনি একটি জায়গা। বিশ্বের সেরা বিমানবন্দরের তালিকায় ২৯ নাম্বারে এর অবস্থান। আমেরিকার পঞ্চম ব্যস্ততম বিমানবন্দর এটি আর নানা রকম ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ চালু থাকার কারণে থাকে আলোচনার একদম কেন্দ্রবিন্দুতে। ডেনভার বিমানবন্দরের রানওয়ে, প্রবেশদ্বার থেকে টানেল পর্যন্ত প্রতিটি অংশ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। অনেকে মনে করেন বিমানবন্দরটি কোনো ভৌতিক কর্মকাণ্ডের অংশ। কারো কারো ধারণা এটি বানিয়েছে নাৎসি বাহিনী, অনেকে আবার ভাবেন এটি এলিয়েনদের আবাসস্থল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য যুক্তি ও তথ্য-প্রমাণ দিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করতে পারেনি কোনো পক্ষ।

◤ ডেনভার বিমানবন্দরের অদ্ভুতুড়ে স্ট্রাকচার ◢

 

বিমানবন্দরের অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানাকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কন্সপিরেসি থিওরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কন্সপিরেসি থিওরি মূলত কোনো ঘটনার এমন ব্যাখ্যাকে বোঝায়, যা সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে। যার পেছনে সরকার (রাষ্ট্র) বা ক্ষমতাশীল কোনো সংগঠনকে দায়ী করা হয় এই যুক্তিতে যে, তারা অসৎ উপায়ে এবং ক্ষতিকর পন্থায় নিজেদের লাভ নিশ্চিত করতে চায়। এরকম তত্ত্বগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো এমন পরিবেশ বা অবস্থা সৃষ্টি করে যা ইতিহাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে সাধারণ বোধের (সরল সত্যতার) সাথে সাংঘর্ষিক। সাধারণত কোনো দ্বৈব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার জন্য এই থিওরির প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু এই বিমানবন্দরের বেশ কিছু ব্যাপারকে দ্বৈব ঘটনার সাথে জড়িত ধরা হয়, এখানেও ডালপালা মেলেছে কন্সপিরেসি থিওরি।

জেনে অবাক হবেন, এই বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠার কোনো যৌক্তিক কারণ ছিল না। কেননা এর ঠিক কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই একটি উন্নতমানের বিমানবন্দর ছিল। তবু প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে বিমানবন্দরটি তৈরি করার পেছনের যুক্তি অনেকেই খুঁজে পান না। সাধারণ ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে সেই বিমানবন্দরটি পুরাতন হয়ে যাওয়ায় এবং রানওয়ে অপ্রতুল থাকায় নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের প্রয়োজন পড়ে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীদের প্রশ্ন হলো, পুরাতন হয়ে গেলেই যে বিমানবন্দর বাতিল হয়ে যাবে? এমন হলে তো বাকি বিমানবন্দরগুলোও বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। আর চাইলে তো রানওয়ে সংযোজন করা যেত। এরজন্য এত কাছাকাছি নতুন বিমানবন্দর বানানোর কোনো দরকার ছিল না। যে টাকা দিয়ে বিমানবন্দর বানানো হয়ছে, দশ ভাগের এক ভাগ দিয়েই হয়ে যেত অনেকগুলো রানওয়ে।

◤ বিমানবন্দর নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক ◢

 

যেই প্রতিষ্ঠান এই বিমানবন্দর বানিয়েছে তাদের নাম The New World Airport Commission. কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো পরবর্তীকালে খোঁজ নিয়ে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। সন্দেহের দানা তখন আরো বড় হয়ে বাঁধতে থাকে। কেননা ‘New World Order’ হলো কথিত গুপ্ত সংগঠন ইলুমিনাতির একটি স্লোগান। এই স্লোগানের মাধ্যমে ইলুমিনাতি বুঝিয়ে থাকে শুধুমাত্র তাদের সিদ্ধান্তেই পৃথিবী চলবে। আর এই New World Order বাস্তবায়নে ইলুমিনাতি ইতোমধ্যেই কাজ করছে বলে অনেকে বিশ্বাস করে থাকেন। ঘিয়ে আগুন ঢালার মতো আরেকটি ব্যাপার হলো, ইলুমিনাতির মতোই আরেকটি গুপ্ত সংগঠন ফ্রিমেসনিজমদের মধ্যে র‍্যাংকিং সিস্টেম রয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ র‍্যাংক হলো ৩৩। এবার একটু খেয়াল করুন এটি তৈরি করা হয় ১৯৯৪ এর ১৯ মার্চ। এবার সংখ্যাগুলোকে যোগ করুন, ১+৯+১+৯+৯+৪= ৩৩। কী বলবেন? কাকতালীয়? ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা তা মনে করে না।

এই বিমানবন্দরের স্ট্রাকচারও এমন যে সহজে কেউ এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না। মোট ৫৩ বর্গমাইলের এই বিমানবন্দরে রয়েছে বিশাল রেস্ট্রিক্টেড এরিয়া। যেটা অন্য কোনো বিমানবন্দরে দেখা যায় না। এত বিশাল জায়গাকে রেস্ট্রিক্টেড রেখে সেখানে কী কারসাজি হয় তা জানা যায় না বলেই হয়তো সন্দেহরা আরো বৃহৎ হয়ে ওঠে।

বিমানবন্দরটির বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে অদ্ভুত সব স্ট্রাকচার। প্রথমেই বলতে হয় ঘোড়ার কথা। বিমানবন্দরে ঢোকার মুখেই রয়েছে ৩২ ফুট উঁচু একটি রক্তচোখা ঘোড়ার মূর্তি। যেটি এয়ারপোর্ট তৈরির আগে থেকেই কারা যে তৈরি করে রেখেছে, তারও কোনো হদিস মেলে না। স্থানীয়রা ঘোড়মূর্তিটিকে ব্লুসিফার নামে ডাকে। তারা মনে করে প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটি রক্তচোখে সবাইকে দেখে।

◤ ব্লুসিফার ◢

 

স্বস্তিকা (卐 বা 卍) চিহ্নকে পশ্চিমা বিশ্বে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু হিটলার যখন থেকে চিহ্নটি ব্যবহার করতে শুরু করলেন তখন থেকে অনেকেই এটাকে নাৎসিদের চিহ্ন হিসেবে জানেন। একই সাথে চিহ্নটিকে বিভিন্ন শয়তানের মন্ত্র হিসেবেও ধরে নেওয়া হয়। জেনে অবাক হবেন এই বন্দরের রানওয়ে উপর থেকে দেখতে একেবারে স্বস্তিকা চিহ্নের মতো। অদ্ভুত সব দেয়াল চিত্র, মূর্তি এসবকে এলিয়েনদের সাংকেতিক ভাষা হিসেবে অভিযোগ করা হয়ে থাকে।

◤ স্বস্তিকা চিহ্নের আদলে রানওয়ে ◢

 

এই বিমানবন্দর নিয়ে এমনসব কথা চালু হওয়ার পেছনে আরেকটি পালক জুড়ে দিয়েছে দেয়ালে থাকা চিত্রকর্মগুলো। যেগুলোর একটিতে একটি বাভারিয়ান শিশুকে দেখা যায় চাকু সংগ্রহ করতে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাচীন মিশরের মৃত্যুর দেবতা আনুবিসের মূর্তি, সুটকেস থেকে বেরিয়ে আসা শয়তানের চিত্র ইত্যাদি যে কোনো মানুষের মনেই প্রশ্ন তুলতে পারে, এমনি এমনি কি একটা জায়গায় এসব চিত্রকর্ম থাকবে? পাশাপাশি গ্যাস মাস্ক পরা একজন নাৎসি অফিসারের ছবিও দেখা যায়। যদিও পরবর্তীসময়ে এমন বিতর্কিত অনেক কিছুই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সরিয়ে ফেললেই কি বিতর্ক বন্ধ হয়ে যায়?

◤ রহস্যময় দেয়ালচিত্র ◢

 

ডেনভার বিমানবন্দরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এর গোপন বাঙ্কারগুলো। সত্যিকার অর্থেই সেখানে প্রয়োজনের চেয়ে বিশাল বড় বাঙ্কার রয়েছে যার আয়তন প্রায় ৪৭০,০০০ বর্গফুট। ফলে এই বন্দরকে বলা হচ্ছে এলিয়েনদের আবাসভূমি। ধারণা করা হয় এখানে এলিয়েনরা থাকে। পাশাপাশি ইলুমিনাতি এবং ফ্রিমেসনিজমদের জন্যেও এটা একটা আশ্রয় স্থল। আরকটি মিথ চালু আছে, বিশ্বের সব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা পারমাণবিক আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এখানে এসে আশ্রয় নেবেন।

এসব ঘটনা নিয়ে আলোড়ন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ২০১২ সালে ট্রু টিভিতে Conspiracy Theory with Jesse Ventura নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারের পরে। যেখানে বিভিন্ন ব্যক্তির কথাবার্তার মাধ্যমে উঠে আসে এই বিমানবন্দরের সাথে ফ্রিমেসনিজমের সম্পৃক্ততা, এলিয়েন ও অদৃশ্য শক্তির আনাগোনার কথা। বলা হয় সেই বাঙ্কারে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের জায়গা হবে। যেটি আগত বৈশ্বিক বিপর্যয় মোকাবেলা করে বাঁচিয়ে রাখবে কেবল এলিট সমাজের লোকদের।

ডেনভার বিমানবন্দরের রয়েছে দীর্ঘ টানেল। এই টানেল নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। প্রতিষ্ঠার পরে এর ব্যাগেজ চেকিং সিস্টেম কাজ করত না। পরে বেশ কিছু টাকা ব্যয় করে মেরামত করার পরেও একই সমস্যা রয়ে যায়। ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরা মনে করেন এই দীর্ঘ টানেলে এলিয়েনের বসবাস রয়েছে। যদিও মেইনস্ট্রিম পৃথিবীর কাজই এসবকে গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া।

এ সম্পর্কিত আরও খবর