নব্বইয়ের দশকের ঢাকা

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 10:41:12

ঢাকা। অনেকের জন্য জাদুর শহর, অনেকের কাছে জ্যামের। বহু মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে এই ঢাকা, আবার কেড়েও নিয়েছে অগণিতের। কারো জীবনকে করেছে রঙিন, কাউকে করেছে নিঃস্ব। ভালো আর খারাপে মিশে একসময়ের সুনশান নীরব ঢাকা আজ হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম জনবসতিপূর্ণ শহর। এই শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে হাজারও ব্যক্তিগত গল্প, প্রতিটি ইটের গাঁথুনিজুড়ে রয়েছে ঘাম আর রক্তের গোপন কাহিনী। এই ঢাকা তাই হয়ে উঠেছে ব্যথার মতো প্রিয় এক শহর।

আজকে আমরা বিশ্বের অন্যতম বসবাস-অযোগ্য, জ্যামে-ঘামে দূষিত যে মেগা সিটিকে দেখি, তা কিন্তু দু দশক আগেও এমন ছিল না। যারা নব্বই দশকে ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন, তাদের চোখে আজকের এই ঢাকা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।

আজকে আমরা মুখরিত যেসব জনপদ দেখি, এর অধিকাংশই ছিল জনমানবহীন। মাঠের পর মাঠ, গাছগাছালিতে পূর্ণ ছিল আজকের এই ঢাকার বহু জনপদ। আজ যেভাবে সকালবেলা একটু শরীরচর্চা করতে হলেও যেতে হয় পার্কে কিংবা দূরের কোনো উন্মুক্ত স্থানে, নব্বই দশকেও ছিল না এমন চিত্র। বার্গার, স্যান্ডউইচ আর বিদেশি খাবারের রেস্তোরাঁয় শহর সয়লাব হওয়ার আগে আমাদের ভালোবাসার জায়গা জুড়ে ছিল রিং চিপস, চিজ বল কিংবা কাঠের বাক্স করে নিয়ে আসা আইস্ক্রিম। কখনো হাতের তালুতে হজমি নিয়ে জিহ্বার আগায় তুলে নেওয়া। আহ কী স্বাদ!

আজকের হরেক রকমের খেলনার মতো নব্বই দশকে কিন্তু এত আধুনিক খেলনাও দেখা যেত না। সেসময় সবার হাতে হাতে থাকত ইয়োইয়ো। তাও আবার স্কুলব্যাগে করে লুকিয়ে নিয়ে যেতে হতো। স্কুল ছুটি হলেই শুরু হতো ইয়োইয়ো প্রতিযোগিতা। কে কত দ্রুত ও কতরকমভাবে ঘোরাতে পারে সেটিই ছিল দেখার বিষয়।

◤ ইয়োইয়ো ◢

 

নব্বইয়ের ঢাকায় লাটিম ছিল অন্যতম আকর্ষণ। লাটিমের পেরেকে দড়ি বেঁধে শুরু হতো প্রতিযোগিতা। ঢাকার তৎকালীন কিশোর-তরুণরা ছিল অনেকরকমভাবে লাটিম ঘোরানোয় দক্ষ। ছিল পর্যাপ্ত খালি জায়গা। হতো মারবেল, সাতচাড়া, গোল্লাছুটের মতো খেলা। তৎকালীন ঢাকাবাসি সাঁতার জানত। পানিতে নেমে বরফ পানি খেলে কাটিয়ে দিত আস্ত একেকটা দুপুর। সন্ধ্যার হালকা আলোয় জমে উঠত লুকোচুরি খেলা।

শুধু কি তাই? রাতেও বাদ যেত না নানা ধরনের ঘরোয়া খেলাধুলা। বিশেষত কাজিনরা একত্র হলে চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ খেলা ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। পরিবারের সদস্যরা সবাই গোল হয়ে লুডু খেলছে এ দৃশ্য আজকের ঢাকায় কল্পনাতীত হলেও নব্বয়ের ঢাকায় ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। পারিবারিক বন্ধন ছিল অনেক গভীর। আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশি সবাই ছিল আন্তরিক, একে অন্যকে চিনত। এখন যেরকম পাশের ফ্লাটে কী হচ্ছে অনেক সময় তা খবরের কাগজেই প্রথম দেখতে হয়, তখনকার পরিস্থিতি মোটেও এমন ছিল না।

◤ লাটিম ◢

 

তখনও ঢাকায় বইমেলা হতো। এখন বইমেলায় ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি, মিডিয়ার ভিড়। তখন এসব ছিল না। বরং সত্যিকার বইপ্রেমীদেরই মিলনমেলা হয়ে উঠত। মেলাকে কেন্দ্র করে চলত উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর নিরাপত্তাজনিত আড়ম্বর না থাকায় স্বতঃস্ফূর্ত ছিল আগতদের যাতায়াত। সার্বিক পরিস্থিতিই ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি উৎসবমুখর। মোবাইল, টেলিভিশন সহজলভ্য না থাকায় বইয়ের পাঠকও ছিল বেশি।

◤ নব্বই দশকের বইমেলা ◢

 

চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকী, টিনটিন আর আর্চির কথা ইতাদি কমিকস সিরিজ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তৎকালীন ঢাকায়। পাঠ্যবইয়ের ভেতর লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়া আর কখনো-বা ধরা খেয়ে মায়ের হাতের উত্তম-মাধ্যম খাওয়ার সেসব লোমহর্ষক স্মৃতি এখনো মন খারাপ করে দেবে নব্বইয়ের কিশোর-তরুণদের।

নব্বই দশকেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ডলসি ভিটার আইস্ক্রিম, চায়নিজ কিংবা পার্লার। তখন অবশ্য সকলে পার্লারে যেতে পারত না। উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা, মাঝবয়সী নারীরা কেবল শুরু করেছিল তখন। ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোও জনপ্রিয় হতে শুরু করে সেসময়ে। বাহারি নামে নিয়ে আসতে লাগল দোকানগুলো। ঢাকার পালে ধীরে ধীরে তখন বদলে যাওয়ার হাওয়া লাগছে।

বুড়িগঙ্গা আজকের মতো এত দূষিত ছিল না তখনও। দুয়েকটা পাল তোলা নৌকাও দেখা যেত। ছিল ছোট-মাঝারি নানা সাইজের লঞ্চ। যতই মানুষের চাপ বাড়তে শুরু করল বড় হতে লাগল ঢাকামুখী লঞ্চগুলো। দ্রুতই হারিয়ে গেল পাল তোলা নৌকা।

◤ চাচা চৌধুরীর কমিকস ◢ 

 

এখনকার মতো এত টিভি চ্যানেল ছিল না তখন। অনেককেই দেখা যেত বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে এন্টেনা ঘোরাচ্ছে আর ঘন ঘন জিজ্ঞেস করছে, “ক্লিয়ার আসছে, আসছে?” বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল তখনও মধ্যবিত্তের আওতায় আসেনি। সাপ্লিমেন্ট হিসেবে কোনো কোনো ঘরে ভিসিআর থাকত, এটুকুই। বিটিভিতে প্রচারিত তখনকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান, নাটক এখনো বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাধিক দর্শকনন্দিত। হুমায়ূন আহমেদের নাটক কোথাও কেউ নেই পেয়েছিল আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা। নাটকটির শেষ পর্বে বাকের ভাইয়ের (নাটকের মূল চরিত্র) ফাঁসি ঠেকাতে তখন ঢাকার রাস্তায় নেমেছিল মিছিল। জনপ্রিয় ছিল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান—‘ইত্যাদি’, ‘ঈদ আনন্দমেলা’, ‘যদি কিছু মনে না করেন’ প্রভৃতি। দর্শকপ্রিয় টিভি নাটকের মধ্যে বহুব্রীহি, সংশপ্তক, এইসব দিনরাত্রি উল্লেখযোগ্য।

তবে এসব ছাড়াও বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল শুক্রবারের সিনেমা। সারা দেশই যেন এই সময়টায় থেমে যেত। পাশাপাশি বেশ কিছু কার্টুনও জনপ্রিয়তা পায় নব্বয়ের ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশেই। শিক্ষামূলক মিনা কার্টুন এ তালিকায় অগ্রগণ্য।

◤ কোথায় কেউ নেই নাটকের মূল দুই চরিত্র বাকের ভাই (আসাদুজ্জামান নূর) এবং মুনা (সুবর্ণা মোস্তফা) ◢

 

তখন বিটিভির কল্যাণেই এদেশের মানুষ আলিফ লায়লা, হাতেম তাই, হারকিউলিস, ম্যাকগাইভারের মতো বিদেশি টিভি সিরিজের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিল। সন্ধ্যা হলে সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করত এসব সিরিজ। সেই সময়েই দেশে প্রবেশ করল স্যাটেলাইট চ্যানেলের সুবিধা। অনেকের বাসায় শোভা পেল ছাতার মতো ডিশ এন্টেনা। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিস্কোভারিসহ বেশ কিছু ভারতীয় চ্যানেলের প্রচার শুরু হলো। আর তার প্রভাব পড়তে শুরু করল দেশের স্থানীয় বাজারে। ইন্ডিয়ান নায়িকাদের মতো করে কাপড়চোপড় পরার চলও হলো তখনই।

ঢাকাই সিনেমাতেও তখন সুসময়। সালমান শাহ, রিয়াজ, ফেরদৌসরা মাতিয়ে রেখেছিল সিনেমা পাড়া। কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির মাধ্যমে সিনেমায় আসা সালমান শাহের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে থাকা অবস্থায় আকস্মিকভাবে তার মৃত্যুতে থমকে গিয়েছিল নব্বই দশকের বাংলাদেশ।

◤ কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমার পোস্টার ◢

 

এখন যেমন প্রিয় তারকার ছবি আমাদের ফোনে বা পিসিতে থাকে, তখন থাকত ঘরের দেয়ালে কিংবা খাটের নিচে। প্রিয় নায়কের বা নায়িকার ছবি ঝুলিয়ে রাখতেন অনেকেই। রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হয়ে কেউ কেউ দেয়ালে টাঙাতে না পারলেও ঠিকই রেখে দিত বিছানার তোশকের নিচে।

নব্বইয়ের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল দশকের শুরুতেই এরশাদের পতন। এছাড়াও নানা রকম রাজনৈতিক অস্থিরতায় শহরে তখন হরতাল, টায়ার পোড়ানো ও গাড়ি ভাঙচুর ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা।

সেই সময়েই দেশে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ইংলিশ মিডিয়াম ইংলিশ স্কুল। ভ্যালেন্টাইন ডে, ফাল্গুন উৎসব, ফ্রেন্ডশিপ ডে উদযাপনের প্রচলনও একই সময়েই ঘটে। এখনকার মতো ফেসবুক না থাকলেও ইয়াহু মেসেঞ্জার, মিগ থার্টি থ্রি কিংবা এসএসএনের মাধ্যমে অনলাইন ভিত্তিক চ্যাটিং কালচার তখনই শুরু হয়।

◤ ৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারায় বাংলাদেশ ◢

 

নব্বই দশকেই দেশে ফুটবলকে ছাপিয়ে জনপ্রিয়তা পায় ক্রিকেট। আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে ক্রিকেটে নিজেদের প্রথম অর্জন বাংলাদেশকে ভাসিয়েছিল উন্মাদনায়। সেই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম উৎসবমুখর দিন ছিল। এরপর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দেওয়া বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ দিয়েছিল পুরো জাতিকে। আহ! সেইসব দিনগুলো। ইত্যাকার স্মৃতির বহরে ভরিয়ে প্রকৃতির নিয়মে হারিয়ে গেছে আমাদের নব্বই দশক—আমাদের রেখে দিয়ে গেছে ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হতে থাকা একটি শহরে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর