মানুষের ক্রমোজমে নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 16:42:06

সময়ের স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে বলে ভাবা হলেও কখনো কখনো কিছু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়—অনুসন্ধান করা খুবই কঠিন—এমনসব জায়গায়। তা প্রাচীন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ হোক, বা দাদীমার আমলের চিলেকোঠাই হোক। আর মানব জিনের বেলায়, জিনবিজ্ঞানীরাও এমন অপ্রকাশ্য, অজানা জায়গায় পৌঁছেছেন, যেখানে ইতঃপূর্বে আর কেউ যেতে পারেনি। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা শেষে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একদল গবেষক যা খুঁজে পেয়েছেন, তা আসলেই ঐতিহাসিক—নিয়ান্ডারথালের ডিএনএ লুকিয়ে আছে মনুষ্য জিনে যা এর আগে কখনোই বোঝা যায়নি।

এই আবিষ্কারকে বুঝতে হলে প্রথমেই আপনার বুঝতে হবে ক্রমোজমকে। ক্রমোজম হলো সেই কাঠামো যা আপনার শরীরের প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে। এটাকে হয়তো আপনারা ইংরেজি এক্স আকৃতির জিনিস হিসেবে দেখতে পেয়েছেন টেক্সটবুক ডায়াগ্রাম ও বিজ্ঞান নিবন্ধগুলোতে। সেটি ভুল না হলেও এতে একটু ভ্রান্তির অবকাশ রয়েছে। ক্রমোজমগুলো বেশিরভাগ সময়ই ডিএনএতে বিশৃঙ্খলভাবে ঝুলে থাকে। কেবল যখন কোষগুলো ক্রমোজমগুলোকে বিভাজিত করতে তৈরি থাকে, তখনই সেগুলো টেক্সটবুকে আমাদের দেখতে পাওয়া ছবির মতো রূপ ধারণ করে।

বিভাজনের জন্য একটি কোষ প্রস্তুত হলে সেই ডিএনএ’র সুদীর্ঘ অংশগুলো পরিণত হয় পেঁচানো ৪৬টি আলাদা ক্রোমোজমে। তখনও তা অবশ্য ‘এক্স’-এর মতো আকৃতি ধারণ করে না। ওগুলোকে তখন দেখতে লাগে অনেকটা ইংরাজি ‘আই’ অক্ষরের মতো। সেই ৪৬টি ক্রোমোজম আসলে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম যা আপনি বাবা-মায়ের থেকে আলাদা আলাদাভাবে পেয়েছেন। কিন্তু এই জোড়াগুলো একটার সাথে আরেকটা যুক্ত নয়।

কোষ বিভাজন আপনার ৪৬টি ক্রমোজমের প্রতিটিকে নিজের একটি প্রতিলিপি তৈরি করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একে বলে ক্রোমাটিড, যা নিজের সুরক্ষার জন্য সেন্ট্রোমেয়ার নামে পরিচিত কেন্দ্রীয় অংশের সাথে সংযুক্ত হয়। এই পর্যায়ে, নিউক্লিয়াসের প্রতিটি প্রান্তের বিশেষ অরগানেলস থেকে মাইক্রোটিউবুলস নামে আঁশের মতো ক্ষুদ্র অংশ বের হয়ে আসে আর যুক্ত হয় প্রতিটি এক্স আকৃতির ডাবল ক্রমোজমের সাথে। সবশেষে, নিউক্লিয়াসের প্রতিটি প্রান্ত থেকে ক্রমাটিডকে আলাদা করে দেয় মাইক্রোটিউবুলস। বিভাজনের স্বাভাবিক নিয়মেই এটি ঘটে। সেই দুটো ক্রমাটিড তখন তাদের ভিন্ন ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়, যাতে করে প্রতিটি একেবারে আনকোরা একটি কন্যা-কোষে পরিণত হতে পারে।

কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াকে বলে মাইটোসিস। কিন্তু শরীর যখন ডিম্বাণু বা শুক্রাণু উৎপাদন করে, সেই প্রক্রিয়াকে বলে মেইওসিস, যা আদতে একটু ভিন্নধর্মী প্রক্রিয়া। এইক্ষেত্রে, প্রতিটি এক্স-আকৃতির ডাবল ক্রমোজম বাবা-মায়ের একজনের থেকে আসা সম্পর্কযুক্ত পার্টনারের সাথে জোট বাঁধে। প্রতিটি এক্স থেকে আসা ক্রমাটিডস একসাথে যুক্ত হয় এবং ডিএনএ’র বিনিময় প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ায়। যেমন, চোখের রঙের জন্য আমি নেব তোমার অংশ আর তুমি নাও আমারটা, অথবা উচ্চতার অংশের জন্য তুমি আমারটা নাও আর আমি নেব তোমারটা। এই চারটি সম্পর্কযুক্ত ক্রমাটিড থেকে গঠিত হয় চারটি ডিম্বাণু বা শুক্রাণু। এই মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে জিনগত প্রকৃতি তৈরি হয়, যা কোনো শিশুকে দেয় অন্যান্য শিশুর থেকে ভিন্ন ধরনের গুণাবলি। আপনার পরিচিত প্রায় প্রতিটি জিনকে খুঁজে পাওয়া যায় ক্রমোজমের বাইরের অংশে। এক্সের দুই বাহুতে, যেমনটা তা থাকে আর কী!—লাইফ জার্নালে প্রকাশিত নতুন পর্যবেক্ষণে জিনবিজ্ঞানীরা সেন্ট্রোমেয়ার বা এক্সের প্রতিচ্ছেদকে পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেই অংশের ডিএনএগুলো পুনরাবৃত্তিমূলক ক্রমে ভরা। একারণে সেগুলোর মানচিত্র তৈরি করা আসলেই বেশ কঠিন। “এটি জিনের ছায়াঘেরা রহস্যময় অংশ। সেখানে না যেতে আমরা সাবধান করে দিয়েছি ছাত্রদের”, সম্প্রতি এক প্রেস রিলিজে এটাই বলেন জ্যেষ্ঠ লেখক চার্লস ল্যাংলি।

রহস্যময় অজানা অংশে অভিযান
সেন্ট্রোমেয়ারে জিনকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন একটা কাজ, কেননা মেইওসিসের সময় সেন্ট্রোমিটার প্রতিচ্ছেদে অংশ নেয় না। এর অর্থ হলো, এতে হাজার হাজার বছর ধরে নির্বিঘ্নে বসবাস করা জিন থাকতে পারে। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, জিনের বিশাল সব দল থাকতে পারে যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া গিয়েছে। এটিকে বলে হ্যাপলোটাইপস, যেটি কিনা সম্প্রসারিত হয়েছে এই অঞ্চল পর্যন্ত। সেটাকে খুঁজে পেতে গবেষক দল সেন্ট্রোমেয়ারের আশেপাশে একটি নির্দিষ্ট জিনের তালাশ করেছেন, যা কিনা তাদেরকে সুযোগ দেবে সাধারণ হ্যাপলোটাইপসকে চিহ্নিত করার। নিঃসন্দেহে এটিই তাদের সেন্ট্রোমেরিক হ্যাপলোটাইপসকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে ফলের মাছি ও মানুষ, উভয়ের ডিএনএ’তেই ।

◤ দেখতে অনেকটা এরকমই ছিল নিয়ান্ডারথাল মানুষেরা ◢ 

 

আসলে তারা খুঁজে পেয়েছেন কী? একটি ক্রমোজমে তারা ৫০,০০০ বছর ধরে থাকা হ্যাপলোটাইপসকে খুঁজে পেয়েছেন। এই সময়ের কিছু পরেই মানবজাতি আফ্রিকা ছেড়ে খুঁজে ফিরছিল নতুন আশ্রয়। আরেকটি ক্রমোজমে তারা খুঁজে পেয়েছে নিয়ান্ডারথাল ডিএনএ, যা সেখানে আছে ৭০০,০০০ বছর ধরে। এই সময়ের কিছু আগে আমাদের মানব পূর্বপুরুষরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল নিয়ান্ডারথালদের পূর্বপুরুষদের থেকে। আরেকটি ক্রমোজমে তারা আরো পুরাতন হ্যাপলোটাইপ পেয়েছেন। সেটা কার থেকে এসেছে, তা অবশ্য বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পারেননি।

আমাদের ক্রমোজমের রহস্যময় ও অজানা অংশে প্রাচীন ডিএনএ’র অনুসন্ধানের এটা কেবলই শুরু। কিন্তু আরো বেশি আধুনিক একটি প্রয়োগক্ষেত্র রয়েছে। যদি বিজ্ঞানীরা সেন্ট্রোমেয়ারসের ওপর নির্ভর করে ক্রমোজমগুলোর মধ্যকার পার্থক্য বুঝতে পারেন, তাহলে তারা এটাও বলতে পারবেন যে একটি ডিম্বাণু বা শুক্রাণু থেকে কোন সেন্ট্রোমেয়ার হ্যাপলোটাইপটা একজন ব্যক্তি পেয়েছে। এমনটাও হতে পারে, কিছু হ্যাপলোটাইপ পাওয়া গিয়েছে বেশি পরিমাণে প্রস্তুত অবস্থায় অথবা সেগুলো অন্যগুলোর তুলনায় বেশি পরিমাণে ঝুঁকিপ্রবণ। আবিষ্কার বা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এটাকেই বিবেচনা করা যেতে পারে প্রথম ধাপ হিসেবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর