হাওড়া ব্রিজের সাতকাহন

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-08-31 04:51:45

কলকাতা বেড়াতে গিয়ে হাওড়া ব্রিজ দেখেন নি, এমন মানুষ বিরল। কলকাতা শহরকে মানুষ যে সব সিম্বল বা প্রতীকের মাধ্যমে চেনে, তার অন্যতম হাওড়া ব্রিজ। ব্রিজটিকে কলকাতার আইকন বললেও ভুল হয় না।

উত্তর কলকাতার বিখ্যাত বড়বাজার, ফুলের বিশাল আড়ৎ, প্রাচীন জনপদ পেরিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেক বার হাওড়া ব্রিজের কাছে গিয়েছি। বাসে কিংবা নদী পথের হাওড়া যেতে ব্রিজটি অতিক্রম করেছি। অদ্ভুত ভালো লাগা টের পেয়েছি প্রতিবারই।

১৯৩৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে থেমে থেমে ব্রিজটি তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ১৯৪২ সালে। কলকাতায় তখন প্রায়ই জাপানি বোমা পড়ছে। ফলে তখনই ব্রিজটি উদ্বোধন করা হয় নি। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ১৯৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একটি ট্রাম চালিয়ে ব্রিজটি জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

যত বারই হাওড়া ব্রিজ দেখেছি, মনে হয়েছে ‘ইস্পাতের মহাকাব্য’। মোট ২৬,৫০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে ব্রিজটির নির্মাণ কাজে। এর মধ্যে ইংল্যান্ডে থেকে আনা হয় ৩,৫০০ টন ইস্পাত আর বাকি ২৩,০০০ টন হাই টেনসাইল ইস্পাত সরবরাহ করে জামশেদপুরের টাটা স্টিল। তৎকালের বিবেচনায় আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর ব্রিজটি নকশা এবং নির্মাণ কাজে কোনও একজন মানুষ বা একটি কোম্পানির কৃতিত্ব নেই। সেই আমলে ব্রিটিশ, জার্মানি, ভারতীয় বহু ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ব্রিজের নির্মাণ কাজের নানা পর্যায়ে জড়িত ছিল। তবে, কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে হুগলি নদীর ওপর দু’টি স্তম্ভ বা পিলারের ওপর ভর দিয়ে ঝুলে থাকা সেতু নির্মাণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে সর্বপ্রথম একটি প্রতিবেদন পেশ করেন আর এন মুখার্জি নামের এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার। ১৯২১ সালে তিনি যে সম্ভাব্যতা নির্ণয়কারী প্রতিবেদন দাখিল করেন, তারই ভিত্তিতে পরবর্তিতে ব্রিজটি নির্মিত হয়।

দিনে ও রাতে নান্দনিক হাওড়া ব্রিজের বাইরের দিকগুলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ভেতরের অন্য একটি রূপ কিন্তু অনেকের কাছেই অজানা। হাওড়া ব্রিজের মোট ২২ লক্ষ বর্গ মিটার বা ২ কোটি ৪০ লক্ষ বর্গ ফুট আয়তনের ইস্পাত কাঠামোতে এক কোট জিংক ক্লোমেট প্রাইমার এবং দুই কোট অ্যালুমিনিয়াম পেইন্ট দিয়ে রং করতে মোট ২৬,০০০ লিটার পেইন্ট ব্যবহার করতে হয়। আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো, হাওড়া ব্রিজের ইস্পাতে পাখিদের বিষ্ঠা এবং মানুষের থুতু ও পানের পিক ইত্যাদি নোংরা পরিষ্কার করতে বছরে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে হয়! অশীতিপর ইস্পাত সেতুকে ঝাঁ-চকচকে রাখাও সহজ কাজ নয়।

যাতায়াত বা যোগাযোগ ছাড়াও মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে, প্রেম-ভালোবাসায়, স্মৃতিতে, চলচ্চিত্রে হাওড়া ব্রিজ জড়িয়ে আছে নিবিড়ভাবে। পরিসংখ্যান বলছে, কমপক্ষে অর্ধশত চলচ্চিত্রে হাওড়া ব্রিজ দেখানো হয়েছে। শুধু বাংলা সিনেমাই নয়, ইংরেজি, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষার বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রে হাওড়া ব্রিজের চিত্রায়ন হয়েছে। বাংলা বা কলকাতাকে উপস্থাপনের জন্য অপরিহার্য প্রতীক হিসাবে হাওড়া ব্রিজ নিজের স্বকীয় বৈশিষ্টে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

সাহিত্যেও হাওড়া ব্রিজের চমৎকার উল্লেখ আছে। অনেক বিখ্যাত উপন্যাসের কাহিনী সেতুর এপার-ওপারে বিস্তৃত হয়েছে। ছড়া ও কবিতায় হাওড়া ব্রিজের উল্লেখের দিক থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ অনন্য। তার কয়েকটি লাইন তাৎপয ও জনপ্রিয়তার গভীর মুগ্ধতায় হাওড়া ব্রিজকে কলকাতার বাঙালি জনসমাজে নিবিড় অঙ্গে পরিণত করেছে: ‘হাওড়া ব্রিজের চুড়োয় উঠুন/নীচে তাকান ঊর্ধে চান/দুটোই মাত্র সম্প্রদায়/নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর