সিরিয়া: রক্ত ও মৃত্যুর জনপদ

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ | 2023-09-01 19:10:54

বিখ্যাত ও সফল ছিলেন হাফেজ আল আসাদ স্নায়ুযুদ্ধের টানটান উত্তেজনার দিনগুলোতে। নিজ দেশ সিরিয়াকে সংঘাত থেকে রেখেছিলেন নিরাপদ। আসাদ পুত্র বাসারের শাসনামলে সেই সফলতার চিহ্ন মাত্র নেই। সিরিয়া এখন হয়ে গেছে রক্ত, মৃত্যু ও সংঘাতে ভস্মিভূত জনপদ।

হাফেজ আল আসাদ পুত্র বাসার আল আসাদ সিরিয়ায় ক্ষমতায় আসেন ২০০০ সালে। পিতার উত্তরাধিকার তিনি সামান্যটুকুও বহন করতে পেরেছেন বলা যাবে না। যে হাফেজ আল আসাদ স্নায়ু য়ুদ্ধের তীব্র উত্তেজনাকর বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিজের দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে যথাসম্ভব রক্ষা করতে সচেষ্ট ছিলেন, সেই আসাদের পুত্র বাসার আল আসাদ নিজের দেশের রক্তাক্ত পরিস্থিতির জনক হয়েছেন।

সিরিয়ায় এখন কমপক্ষে পাঁচটি গ্রুপ পরস্পরের রক্ত ও জীবন নিচ্ছে। সাত লাখ মানুষ মারা গেছে সংঘাতে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক জনতা এবং দেশটির পনের শতাংশ জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি জনপদ নরকে রূপান্তরিক হয়েছে। জীবন নয়, মৃত্যু আর রক্তই এখন সিরিয়ার চলমান বাস্তবতা।

ঘটনার সূত্রপাত ২০১১ সালের মার্চ মাসে। বাসার আল আসাদের শাসনের দশ বছর তখন পেরিয়ে গেছে। উন্নয়নের বদলে বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ভিন্নমতের দলন, দমননীতি তার শাসনকে জনগণের কাছে শ্বাসরোধী পরিস্থিতির সমতুল্য করে ফেলে। ফলে শুরু হয় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন।

প্রথম থেকেই গণআন্দোলনের প্রতি প্রেসিডেন্ট আসাদের সশস্ত্র অবস্থান নেয়ায় ক্রমেই পরিস্থিতি সংঘাতময় রূপ লাভ করে। এক পর্যায়ে সরকার বিরোধী বিদ্রোহীরাও অস্ত্র ধারণ করায় সূচনা হয় গৃহযুদ্ধের। অন্যদিকে, সিরিয়ান কুর্দি জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র তুলে নেয়। মাঠে নামে ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) অস্ত্রধারীরা। দেশটি ভাগ হয়ে যায় অস্ত্রধারী একাধিক গ্রুপের হাতে। দল-উপদলগুলোর পারস্পরিক সশস্ত্র লড়াইয়ে অকাতরে মরতে থাকে সাধারণ মানুষ। গৃহহীন ও উদ্বাস্তু হয় লাখ লাখ নর-নারী-শিশু।

সিরিয়ার সংঘাত প্রথমে দেশটির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও অচীরেই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মাঠে নামে। তৈরি হয় রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক মেরুকরণ। একদিকে ইরান ও লেবাননের শিয়া সম্প্রদায় একজোট হয় আসাদের পক্ষে। সৌদি আরব থাকে বিদ্রোহী জনতার পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের উপর ভর করে আইএস হটাতে আর্বিভূত হয়। রাশিয়াও সশস্ত্র অংশগ্রহণ করে সিরিয়ায়।

ভেতর ও বাইরে থেকে নানা দল ও দেশের সশস্ত্র অংশগ্রহণে সিরিয়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। দিনে দিনে
হতাহতের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেতে থাকে। শান্তি ও সমঝোতার কোনও পথই দেখা যায় না। সংঘাতটি শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় অবয়বের পাশাপাশি কুর্দি জাতিগত ইস্যুকেও সামনে নিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বৈশ্বিক প্রচেষ্টার বিষয়গুলোও সিরিয়ার সংকটকে ঘনীভূত করে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, সিরিয়ান্র রক্তাক্ত পরিস্থিতিকে আয়ত্ত্বে আনার কোনও উদ্যোগই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কমপক্ষে দশটি বৈঠক ও আলোচনা শেষ হয়েছে ফলাফলহীন অবস্থায়। সিরিয়ার ইস্যুতে জাতিসংঘের করুণ ও অসহায় অবস্থান বার বার স্পষ্ট হয়েছে।

সবচেয়ে মারাত্মক যে বিষয়টি সিরিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তা হলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং মানবাধিকার রক্ষাকারীদের শোচনীয় অক্ষমতা। চতুর্মুখী সংঘাতে যে জনপদে পাখির মতো নারী ও শিশুরা মারা যাচ্ছে, রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, মানুষ স্রোতের মতো ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে, সেখানে বিশ্ব বিবেক ও মানবতা নিরব থাকছে। নারী ও শিশু নির্যাতনের বর্বরতম উদাহরণ এবং যৌন হয়রানীর কুৎসিত দৃষ্টান্ত স্থাপনের পরেও সিরিয়ার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী মানবিক বিবেকের আলোড়ন লক্ষ্য করা যায় নি।

ইউরোপের এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে সিরিয়ান রিফিউজিদের মিছিল, খাদ্যের জন্য যৌনতা আদায়, পূর্ব গৌতাসহ অসংখ্য জনপদ ধ্বংস এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও সম্পতি বিনাশের মর্মান্তিক ঘটনার অবসান কবে হবে কেউ জানে না! আসলেই কেউ জানে না যে, রক্ত ও মৃত্যুর জনপদ সিরিয়ায় কবে শান্তি ফিরে আসবে এবং সমাপ্তি ঘটবে রক্তলোলুপদের তাণ্ডব!

বিশ্ব যেন বোবা ও বধির হয়ে দেখছে নারকীয় গণহত্যার উৎসব। দেখছে, সিরিয়া নামের একটি প্রাচীন, সম্মৃদ্ধ, ঐতিহ্যবাহী দেশকে রক্ত ও আগুনের বন্য তাণ্ডবে শ্মশানে পরিণত করার বর্বরতা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর