প্রাচীন মিশরের যে আবিষ্কারগুলো ছিল আধুনিক সভ্যতার ভবিষ্যদ্বাণী

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 23:01:23

নৃতাত্ত্বিক এবং গবেষকদের কাছে প্রাচীন মিশর একটা বিস্ময়। ক্যালেন্ডার থেকে লেখার ধারণা, অপারেশনের যন্ত্রপাতি থেকে আকাশচুম্বি নির্মাণ—মিশরীয় সভ্যতাকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত করেছে। ঠিক কিভাবে পিরামিড কিংবা মমি তৈরি করা হতো, এ নিয়ে এখনো দ্বিধাবিভক্ত গবেষকরা।

প্রাচীনকালে সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। ভারতে সিন্ধু নদ, মেসোপটেমিয়ায় টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর উপকূল এবং চীনে ইয়োলো নদী। মিশরীয় সভ্যতাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। নীল নদের তীরে জন্ম নেওয়া এই সভ্যতা অনেক দিক দিয়েই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে। সভ্যতার কেন্দ্র বলে যে গ্রিকদের কদর করা হয়, সেই গ্রিকরাও মিশরীয়দের কাছে ঋণী। থেলিস, পিথাগোরাস কিংবা খোদ এরিস্টটলের বহু ধারণাই প্রাচীন মিশরীদের থেকে গৃহীত।

যে সব আবিষ্কার মানবসভ্যতার গতিমুখ বদলে দিয়েছে মিশরীয় সভ্যতার এমন কিছু অবদান নিয়েই আজকের আয়োজন।

ধাতব যন্ত্রপাতি

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা টিন এবং তামাকে মিশ্রিত করে ব্রোঞ্জ তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। ব্রোঞ্জ অন্যান্য ধাতু থেকে অধিক স্থায়ী এবং মজবুত। প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে এই যুগ ব্রোঞ্জ যুগ বলে স্বীকৃত। 

◤ বিশেষ করে ব্রোঞ্জের ব্যবহারে তাদের দক্ষতা বিস্ময়কর ◢


ব্রোঞ্জের নির্মিত আসবাবপত্র, অস্ত্র, নির্মাণ কিংবা প্রসাধনী সামগ্রীর হদিস পাওয়া গেছে। আনুপাতিক মিশ্রণ এবং নির্মাণের নিখুঁত পরিকল্পনায় তাদের দক্ষতা প্রমাণিত।

লেখালেখি

প্রাচীন মিশরীয়রাই প্রথম সাংগঠনিকভাবে লেখালেখি করেছে। আর সেই সাথে লেখাগুলিকে জমা করে রেখেছে পরবর্তী কোনো পাঠকের জানার জন্য। জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার ইতিহাসের পত্তন সেখান থেকেই। মিশরীয়রা লেখার জন্য ব্যবহার করত হায়ারোগ্লিফিক। শব্দগুলো ছবির মতো এই ভাষায়। নৃতাত্ত্বিকেরা ১০০০ পৃথক অক্ষরকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

◤ প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক ◢


হায়ারোগ্লিফিক থেকেই উদ্ভুত হয়েছে হায়ারেটিক এবং ডেমোটিক লিপি। পরবর্তী আরমায়িক এবং গ্রিক লিপির জন্মও সেখান থেকে। এ কারণেই মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিককে আধুনিক অনেক ভাষারই পূর্বপুরুষ বলে গণ্য করা যায়।

প্যাপিরাস

প্যাপিরাস গাছের মজ্জা থেকে কাগজ তৈরির কৌশল মিশরীয়রাই প্রথম বের করেছে। পরবর্তীতে তাদের এই অবদান পুরো ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কারণ ভূমধ্যসাগর ছিল উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্বের মধ্যকার বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। কাগজে লিখে পেঁচিয়ে স্ক্রল করে সংগ্রহ করা হতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ লেখা।

প্যাপিরাসের সবচেয়ে প্রাচীন নজির আবিষ্কৃত হয় ২০১২ সালে। লোহিত সাগরের উপকূলে ওয়াদি আল জারফ নামের প্রাচীন অঞ্চলে। আবিষ্কৃত প্যাপিরাস ২৫৬০-২৫৫০ খ্রিস্টপূর্বব্দের বলে শনাক্ত করা হয়েছে। গিজা পিরামিডে খননকার্য চালানোর সময়েও পাওয়া গেছে এর নিদর্শন।

◤ কাগজ, কালি এবং লেখাতে আছে মিশরীদের অবদান ◢


মিশরীয়রা লাইব্রেরির ব্যবহারও সভ্যতাকে উপহার দিয়েছে। সময়ের ব্যবধানে টিকে থাকা একমাত্র লাইব্রেরি টেবটিউনিস মন্দির লাইব্রেরি। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায়।

কালি

খালি কাগজে তো আর লেখা যায় না। সে কথা চিন্তা করেই প্রাচীন মিশরীয়রা প্রথমবারের মতো প্রস্তুত করেছিল কালি। গাছের আঠা, সবজির রস, কিংবা মোম দিয়ে কালি তৈরি করা হতো। আঠা বা রসের সাথে আবার অন্য এক বা একাধিক উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন রঙ।

ষাঁড়ে টানা লাঙল

নদী তীরবর্তীতে সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে প্রধানতম কারণ তাদের কৃষি নির্ভরতা। মিশরীরাও ব্যতিক্রম ছিল তাদের থেকে। তবে মিশরীয়দের অগ্রসরতার প্রমাণ, কৃষির জন্য ব্যবহৃত লাঙলের আবিষ্কার। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে মাটি চাষের জন্য মানুষকে লাঙল টানতে হয়নি; সেই স্থান নিয়েছে ষাঁড়।

◤ মিশরীয়দের প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থা ◢


মিশরীয়রা সবজি এবং গম চাষে বেশ সফলতা দেখিয়েছে। ফসল কাটা কিংবা মাড়াইয়ের জন্যও নিজস্ব ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটিয়েছিল।

খাল এবং নালা

সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রে মিশরীয়রা পালন করেছে পথিকৃতের ভূমিকা। নীল নদ থেকে সবসময় পানি সবখানে পাবার জন্য খাল এবং নালা খনন করা হয়েছিল। তার ফলে নদ থেকে বহু দূরেও জন্ম নিয়েছিল বিশাল চারণভূমি ও ফসলের মাঠ। পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল গেইট। খরার সময় যেন পানির অভাবে বিপর্যয়ে পড়তে না হয়, তার জন্য রাখা হয়েছে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা।

◤ প্রাচীন মিশরীয় সেচ ব্যবস্থায় শাদুফের ব্যবহার ◢


মিশরীয়রা জলচক্র আবিষ্কার করেছিল, যার নাম শাদুফ। জলচক্রের একপাশে থাকত বালতি আর অন্য পাশে একটা ভারী বস্তু। বালতিটি নীল নদে ফেলে পূর্ণ করা হতো আগে। তারপর চাকা ব্যবহার করে উত্তোলন করা এবং ঘুরিয়ে নালার উপরে গিয়ে খালি হতো। এভাবে চলত সেচ।

ক্যালেন্ডার

মানবসভ্যতাকে সৌরপঞ্জিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে মিশরীয়দের অবদান অনন্য। কৃষি সম্পৃক্ততার দরুণই ঋতু সম্পর্কে বেখবর থাকা হয়ে উঠেনি। নির্দিষ্ট দিন পরপর পূর্ব আকাশে লুব্ধক নক্ষত্রের আগমন এবং সেই সাথে নীল নদে জোয়ারের মিলে যাওয়ার ঘটনা তাদের আগ্রহী করে তোলে।

◤ মিশরীয়দের ব্যবহৃত ক্যালেন্ডার ◢


এভাবে উদ্ভাবিত হয় ৩৬৫দিনের ক্যালেন্ডারের ধারণা, যা বিভক্ত ১২ মাসে। প্রত্যেক মাসে ছিল আবার ৩০দিন করে। বছর শেষে পাঁচ দিন উৎসবের দিন বলে গণ্য করা হতো। সামান্য কিছু ত্রুটি থাকলেও পঞ্জিকার ইতিহাসে তাদের এই প্রচেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ।

ঘড়ি

সূর্যঘড়ির জন্য মিশরীয়রা বিশেষভাবে বিখ্যাত। সূর্যঘড়ি হলো একটা দণ্ড পুতে রেখে তার ছায়ার হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব করে সময় বের করার প্রক্রিয়া। দিনের বিভিন্ন সময়কেই নির্দিষ্ট করা সম্ভব হলো না শুধু এর মাধ্যমে; সেই সাথে জানা গেল দিনের দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে।

◤ সূর্যঘড়ি ◢


খ্রিস্টপূর্ব ১৬ শতকের দিকের এক শিলালিপি পাওয়া গেছে মিশরীয় সমাধিতে। সেই সাথে মিলেছে ‘আমেনেমহেট’ নামের তৎকালে বহুল প্রচলিত জলঘড়ি। পাথরের পাত্রের তলায় ক্ষুদ্র ফুটো তৈরি করলে একটা নির্দিষ্ট অনুপাতে পানি এই পাত্র থেকে কমে যেতে। আগে থেকেই পাত্রের গায়ে চিহ্ন আঁকা থাকত। সেই চিহ্ন নির্দেশ করত সময়ের। যাজকেরা রাতে এই ঘড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারণ করত ধর্মীয় আচার পালনের সময়।

খিলান

আধুনিক নির্মাণে খিলানের জনপ্রিয়তা এর প্রয়োজনের জন্যই। দেয়ালের মাঝখানে খালি স্থান রাখার কথা চিন্তা করেই মূলত খিলানের উদ্ভাবন। রোমান সভ্যতায় খিলানের প্রভূত চমৎকারিত্ব আমাদের বিস্মিত করে। তারও আগে খিলানের ব্যবহার করেছে মিশরীয়রা। পাথরের ওপর পাথর রেখে উপরের দিকে কেন্দ্রে মিলিত হতো দুই পাশ।

◤ মিশরীয়দের খিলান ◢


তাদের এই প্রক্রিয়া অতোটা আধুনিক না হলেও প্রভাবশালী। পরবর্তী সভ্যতাগুলো নিজেদের মতো করে গ্রহণ ও উন্নত করেছে একে।

কাচ তৈরি

খ্রিস্টপূর্ব পনের শতকের দিকেই মিশরীয়রা কাচ উৎপাদন এবং ব্যবহার শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। তৈরি হতো বিভিন্ন রঙের কাচের পাত্র এবং আসবাবপত্র। চীনামাটি, বালি কিংবা অনুরূপ পদার্থসমূহকে উত্তপ্ত করে গলিয়ে ফেলা হতো প্রথম দফায়। আকৃতি দেওয়ার জন্য রাখা হতো অনুরূপ মজ্জার চারপাশে। তারপর বেড় এবং হাতল যোগ করার পর সরিয়ে ফেলা হতো ব্যবহৃত মজ্জা।

◤ কাচ উৎপাদনকে তারা নিয়েছিল শিল্পের পর্যায়ে ◢


এই কাচপাত্র চলে যেত ফিনিশীয়, হিব্রু কিংবা গ্রিকদের কাছে। মিশরীয় কাচের সুনাম ছিল গোটা ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল জুড়েই।

আসবাবপত্র

হাওয়ার্ড কার্টার ১৯২৩ সালে তুনেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার করেন। মজার ব্যাপার হলো, সেখানে পাওয়া গেছে অনেক ফার্নিচার। প্রাচীন মিশরীয়রা যে টেবিল, বিছানা, বসার টুল প্রভৃতির সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত ছিল; তা প্রমাণিত।

◤ প্রাচীন মিশরীয় আসবাবপত্র ◢


প্রথমদিকের টেবিলগুলো ওপরে কিছু রাখার জন্য ব্যবহৃত হলেও পরের দিকে বেশিরভাগ ছিল সেনেতের জন্য। সেনেত ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন ঘরোয়া খেলার মধ্যে একটা। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ সালের লিখিত হায়ারোগ্লাফিকেও এর উল্লেখ আছে।

শল্যচিকিৎসার যন্ত্রপাতি

খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ সালের চিকিৎসার প্রণালি লেখা প্যাপিরাসের লিপি পাওয়া গেছে। সেখানে ব্যথা, কাটা, হাড়ভাঙা, স্থানচ্যুতি, ফোঁড়ার মতো ৪৮ প্রকার শল্যচিকিৎসার বিশ্লেষণ, রোগীর পথ্য ও কর্তব্য নিয়ে লেখা আছে। ব্যথাগুলো মূলত বেশির ভাগ মাথা, কাঁধ, গলা, বুক এবং পাঁজর সম্পর্কিত।

◤ শল্যচিকিৎসাতেও তাদের অবদান পৃথিবীর বাঁক ঘুরিয়ে দেবার মতো ◢


অপারেশনের সময় কর্তব্য এবং বিভিন্ন যন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কেও ধারণা দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি ব্যান্ডেজ কিংবা প্লাস্টারের কথাও। কালো আর লাল কালির মিশেলে লেখা লিপিটি কায়রো জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তার সাথে আছে ক্ষুর, শল্যছুরি, ফর্সেপস্, হুক, পিতলের নিডল এবং অন্যান্য অনেক চিকিৎসা বিষয়ক যন্ত্রপাতি।

টুথপেস্ট

মিশরীয়রা টুথপেস্ট আবিষ্কার করেছিল ষাঁড়ের খুড়, ছাই, পোড়া ডিমের খোসা থেকে। এছাড়া রক সল্ট, পুদিনা এবং কিছু নির্দিষ্ট ফুলকে শুকনো করে কাজে লাগানো হতো। সেই সময়ে তাদের এই প্রচেষ্টাই বর্তমানে টুথপেস্ট হিসাবে রূপান্তরিত হয়ে পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত।

◤ এমনকি টুথব্রাশও তাদের আবিষ্কার ◢


মানব সভ্যতার ইতিহাস আবিষ্কারের ইতিহাস। যে সমাজের আবিষ্কারের ঝুলি যত বেশি সমৃদ্ধ, তারা ততো বেশি অগ্রসর। আধুনিক ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দিকে তাকালেই সেকথা উপলব্ধি করা সম্ভব। সেই আবিষ্কারের ইতিহাসে মিশরীয়দের অবদান নির্ধারণ করেছে পরবর্তী পৃথিবীর ভাগ্য। আধুনিক মানব তার দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর জন্যই মিশরীয়দের কাছে ঋণী।

এ সম্পর্কিত আরও খবর