সাসপেন্স চলচ্চিত্রের গুরু আলফ্রেড হিচকক

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-29 15:43:29

গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেওয়ার মতো হরর, থ্রিলার বা সাসপেন্স ছবি উপভোগ করতে যারা ভালোবাসেন, তাদের কাছে আলফ্রেড হিচকক নিঃসন্দেহে এক অবিস্মরণীয় নাম। উত্তেজনার নৌকায় ভর করে, রুদ্ধশ্বাসে আজও দর্শক উপভোগ করেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক আলফ্রেড হিচককের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো। আজ ১৩ আগস্ট এই গুণী পরিচালকের ১২০তম জন্মদিবস।

১৮৯৯ সালের এই দিনে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনের এক ক্যাথলিক পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় পুত্র আলফ্রেডের শৈশব-কৈশোরের পড়ালেখা সম্পন্ন হয়েছিল জিসুইত ক্লাসিক স্কুল এবং সেন্ট ইগনাতিয়াস কলেজ ও সালেসিয়ান কলেজে।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে অদ্ভুত ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি। তার বাবা ছেলের দুষ্টুমির শাস্তি দিতে তাঁকে নিকটবর্তী থানা পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেন, যাতে করে তাঁকে পাঁচ মিনিট বন্দী করে রাখা হয়। আর অল্প বয়সের এরকম অদ্ভুত পরিস্থিতিই হয়তো পরবর্তীকালে তাঁর সিনেমাজুড়ে আতঙ্ক, সাসপেন্স—এ ব্যাপারগুলোকে বেশি আনতে আগ্রহী করে তোলে।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তিনি লন্ডন কাউন্টি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড নেভিগেশনে যান সেন্ট ইগনাতিয়াস ছেড়ে। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি ড্রাফটসম্যান এবং অ্যাডভারটাইজিং ডিজাইনার হিসেবে ক্যাবল কোম্পানি “হেনলি”তে কাজ করেন। সেইসাথে চলতে থাকে তাঁর লেখালেখির কাজও। পরে চলচ্চিত্রকার হলেও এসব লেখা নিঃসন্দেহে তাঁর সৃজনশীল মস্তিষ্ককে জুগিয়েছিল দারুণ শক্তি।

১৯১৯ সালে হেনলি টেলিগ্রাফ প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার প্রথম সংকলনে প্রকাশিত হয় তার লেখা “গ্যাস”। গল্পটি ছিল এক অল্পবয়সী নারীকে কেন্দ্র করে। তার পরবর্তী লেখার নাম ছিল “দ্য ওমেন পার্ট”, এটাও একই বছর প্রকাশিত হয় সেই পত্রিকায়। এখানে একজন স্বামী ও তার স্ত্রীর মাঝে সাংঘর্ষিক জীবনের কথা ফুটে উঠে। এছাড়া “সরডিড”, “এন্ড দেয়ার ওয়াজ নো রেইনবো”র মতো লেখাও তিনি লিখেছেন। তার সর্বশেষ লেখা ছিল “ফেডোরা”, যেখানে তিনি বলতে চেয়েছেন তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী কেমন হবে তা নিয়ে।

১৯২০ সালের দিকে এসে আলফ্রেড হিচকক আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফটোগ্রাফি এবং চলচ্চিত্রের প্রতি। তিনি লন্ডনে ফিল্ম প্রোডাকশনে কাজ করা শুরু করেন। টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন “প্যারামাউন্ট পিকাঁচার”-এর লন্ডন শাখায়। এরপর তিনি কাজ করেন “ইসলিংটন স্টুডিও”তে। সেখানে টাইটেল কার্ড ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে করতে চিত্রপরিচালক হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেন তিনি।

◤ হিচককের পরিচালিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা “দ্য প্লিজার গার্ডেন” ◢


১৯২২ সালে ‘নাম্বার থার্টিন’ নামে চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেন। কিন্তু তার জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটি অসম্পূর্ণই থেকে যায়। এরপর একের পর এক তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যান। আর চলচ্চিত্রে তিনি ফুটিয়ে তুলতে থাকেন তার নান্দনিকতা ও চিন্তাভাবনাগুলোকে। ১৯২৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন “দ্য প্লেজার গার্ডেন”। এটি ছিল তাঁর মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি। এ চলচ্চিত্রটি ছিল ব্রিটিশ-জার্মান প্রোডাকশনের এবং চলচ্চিত্রটি হয় দারুণ জনপ্রিয়। এরপর হিচকককে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, এগিয়ে গিয়েছেন সামনে । বিভিন্ন প্রোডাকশনের ব্যানারে একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যেতে থাকেন তিনি। ১৯২৭ সালে মুক্তি পায় তার চলচ্চিত্র “দ্য লজার”। “দ্য লেডি ভেনিশেস” (১৯৩৮) ও “জ্যামাইকা ইন” (১৯৩৯)-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মাণের পর তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আটলান্টিকের ওপারে আমেরিকাতেও ।

আলফ্রেড হিচকক ১৯৪০ সালে পুরো পরিবার নিয়ে হলিউডে যান। শুরু হয় তার হলিউডে চলচ্চিত্র জীবন। ডেভিডও সেলঝনিকের প্রযোজনায়, তাঁর পরিচালনায় চলচ্চিত্র “রেবেকা” মুক্তি পায় ১৯৪০ সালে। রেবেকা তখন অস্কারের আসরে বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। এরপর হলিউডে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত একের পর এক ক্ল্যাসিক সব চলচ্চিত্র। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, “লাইফবোট” (১৯৪৪), “স্পেলবাউন্ড” (১৯৪৫), “নটোরিয়াস” (১৯৪৬), “রোপ” (১৯৪৮), “স্ট্রেনজার্স অন এ ট্রেইন” (১৯৫১), “ডায়াল এম ফর মার্ডার” (১৯৫৪), “রিয়ার উইন্ডো” (১৯৫৪)।

◤ হিচককের দর্শকনন্দিত ‘ভার্টিগো’ ছবির একটি দৃশ্য ◢


১৯৫৮ আর ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি চলচ্চিত্র যথাক্রমে “ভার্টিগো” আর “নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট”। এরপর আসে সেই বিখ্যাত ১৯৬০ সাল। হিচককের ফিল্মোগ্রাফি ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসময় মুক্তি পাওয়া “সাইকো” (১৯৬০) চলচ্চিত্রটির ব্যবসায়িক সাফল্য আর দর্শকপ্রিয়তা ছিল চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। সম্প্রতি হিচককের সাইকোর সিনেমা নির্মাণের ভিতরের কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র “হিচকক”, যেখানে অ্যান্থনি হপকিন্স অভিনয় করেছেন হিচককের চরিত্রে।

◤ হিচককের সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় সিনেমা “সাইকো”র পোস্টার ◢


সাইকোর পর ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় আরেক সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র “দ্য বার্ডস”। “ফ্যামিলি প্লট” (১৯৭৬) ছিল তার পরিচালিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র। হিচককের ফিল্মোগ্রাফিতে আরেকটি উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে আছে ১৯৫৫ সালে প্রচারিত আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস। এটি ছিল একটি টিভি শো, যার প্রতিটি পর্বের ব্যাপ্তিকাল ছিল ২৫ মিনিট। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই সিরিজটি চলে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত।

১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আলফ্রেড হিচকক আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট লাইফ এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড পান । অনুষ্ঠানে তিনি একটা কথাই বলেন আর তা হচ্ছে চারজন মানুষের কথা। তারা হচ্ছেন এডিটর, লেখক, তার মেয়ে প্যাট এবং তার স্ত্রী আলমা রিভিলি । যাদের স্নেহ, ভালোবাসা ও উৎসাহ ছাড়া তিনি এতদূর আসতে পারতেন না।

“এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি” ম্যাগাজিনে বিশ্বের সেরা একশত চলচ্চিত্রের মধ্যে তার চলচ্চিত্র “সাইকো”, “ভারটিগো”, “নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট” ও “নটোরিয়াস” স্থান পায় । এছাড়া ব্রিটেনের বিখ্যাত এম্পায়ার ম্যাগাজিনের “গ্রেটেস্ট ডিরেক্টরস এভার” তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন হিচকক। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের হান্ড্রেড মোস্ট হার্ট পাউন্ডিং মুভিজ তালিকায় ৯টি সিনেমাই হিচককের। যার মধ্যে প্রথম স্থানটি অর্জন করেছে “সাইকো”।

তিনি গোল্ডেন গ্লোব, সিনেমা জাম্পো অ্যাওয়ার্ড, লরিয়াল অ্যাওয়ার্ড, ডিরেক্টরস গিল্ড অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট অ্যাওয়ার্ড, একাডেমি অ্যাওয়ার্ড-এর সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন।

সিনেমাজগতকে আলফ্রেড হিচককের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার ছিল বড় পর্দায় প্রতিটি দৃশ্যকে এমনভাবে ধারণ করা যেন তা দর্শকের মনে সাসপেন্স বা উদ্বেগ সৃষ্টি করে। তাঁর সৃজনশীল ক্যামেরার কাজ ও দৃষ্টিকোণ, এডিটিংয়ের নিত্যনতুন তরিকা তাঁর ছবিগুলোকে করেছে অনন্য। আর হারমান বার্নার্ডের মিউজিক হিচককের সেরা ছবিগুলোকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। আলফ্রেড হিচকক “অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার্স”-এর আর্ভিং জি থালবার্গ মেমোরিয়াল পুরস্কার পান। আমেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট তাকে “লাইফ অ্যাচিভমেন্ট” সম্মাননায় ভূষিত করে। ১৯৮০ সালে তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হন।

◤ সারাজীবন অসংখ্য পুরস্কার পেলেও তাঁকে দেওয়া হয়নি অস্কার। বিষয়টা বেশ বিস্ময়করই! ◢


কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তিনি কখনো অস্কার জেতেননি। কী কারণে তাঁকে অস্কারের সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্কই রয়েছে। তবে, সাসপেন্সপ্রিয় সাধারণ দর্শকেরা মনেই করতে পারেন—অস্কার না দিয়ে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়নি, তাঁকে পুরষ্কারটি না দিয়ে বঞ্চিত হয়েছে আসলে অস্কার কর্তৃপক্ষই।

অস্কারের চেয়েও অনেক বড় পুরষ্কার—বিশ্বের আপামর সাসপেন্সপ্রিয় দর্শকের কাছে প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়া—তো তিনি পেয়েছেনই।

লেখাটি শেষ করা যাক মজার একটি তথ্য দিয়ে। যদি হিচককের ভয়ংকর চলচ্চিত্রগুলো দেখতে আপনি ভয় পেয়ে থাকেন, তবে জেনে নিন এই দলে আপনি একা নন। স্বয়ং হিচককই নিজের পরিচালিত ছবিগুলো দেখতে ভয় পেতেন। ১৯৬৩ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমি আমার নিজের ছবি দেখতে ভয় পাই। কখনোই ছবিগুলো দেখতে চাই না। না-জানি মানুষ কিভাবে দেখে আমার ছবি!”

কাজেই, কেউ যদি রোমাঞ্চ ও সাসপেন্সপ্রিয় দর্শক হয় এবং এখনো যদি হিচককের কোনো মুভি না দেখে থাকে, তাহলে অবশ্যই সে স্বাগত হিচককের রোমহর্ষক দুনিয়ায়!

এ সম্পর্কিত আরও খবর