জেনে নিন নতুন টাইগার-গুরু রাসেল ডমিঙ্গো সম্পর্কে

, ফিচার

সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-24 01:27:46

সদ্য সমাপ্ত ওয়ানডে বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় স্টিভ রোডসকে ছাঁটাইয়ের পর যখন বিসিবি নতুন কোচ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিল, তাতে সাড়া দিয়ে অন্য সবার আগে ঢাকায় এসেছিলেন এক দক্ষিণ আফ্রিকান। সব যাচাই-বাছাই শেষে ৪৪ বছর বয়সী সেই দক্ষিণ আফ্রিকানকেই নিয়োগ দিয়েছে বিসিবি। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ দলের নতুন হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর কথা—বাইশ গজে ব্যাট-বলের লড়াই ছেড়ে বিশ বছর বয়সেই যিনি নিয়েছিলেন কোচিং-দীক্ষা।

১৯৭৪ সালে পোর্ট এলিজাবেথে জন্ম নেওয়া ডমিঙ্গোর খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার সীমাবদ্ধ থেকেছে ইস্টার্ন প্রভিন্সের যুবদলের মধ্যেই। সিনিয়র দলে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ রাসেল মাত্র বাইশ বছর বয়সেই পেয়ে যান প্রথম কোচিং সনদ, আর ২৫ বছর বয়সে সেই ইস্টার্ন প্রভিন্সে ফিরে আসেন যুবদলের কোচ হিসেবে।

জাতীয় দলে কিংবা ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকে সুনাম কুড়ানোর ঘটনা বিরলই বটে। হিলটন অ্যাকারম্যানের অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় একাডেমিতে কাজ করা ডমিঙ্গো বাংলাদেশে পা রাখেন ২০০৪ সালে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেই আসরে দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ হিসেবে কাজ করা রাসেল ডমিঙ্গো ঠিক তার পরের বছর শীর্ষ ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি ওয়ারিয়র্সের হেড কোচ হিসেবে যোগ দেন। তাঁর হাত ধরেই পরবর্তী পাঁচ মৌসুমে প্রায় ৬ জন ক্রিকেটারের ডাক পড়ে জাতীয় দলে। ২০০৯-১০ মৌসুমে ঘরোয়া ওয়ানডে এবং টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্টের সিংহাসনে বসার পাশাপাশি টানা দুই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টুয়েন্টি আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে ওয়ারিয়র্স। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ডমিঙ্গোর ওয়ারিয়র্স অবশ্য ফাইনালে হেরে যায় আইপিএল শিরোপাধারী চেন্নাই সুপার কিংসের কাছে।

ডমিঙ্গো বাংলাদেশে প্রথম পা রাখেন ২০০৪ সালে


জাতীয় পর্যায়ে কোচিংয়ের সুযোগ লুফে নিতে কখনো দ্বিধা করেননি। ২০১০ সালে ফের বাংলাদেশ যাত্রায় রাসেল দায়িত্ব পান দক্ষিণ আফ্রিকা ‘এ’ দলের। এর পরের বছর নিজভূমে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ফিরতি সফরেও একই পদে বহাল থাকা ডমিঙ্গো সে বছরের জুনেই ডাক পান সিনিয়র দলের কোচিং ইউনিটে। হেড কোচ গ্যারি কারস্টেনের সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ডমিঙ্গোকে এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে অবশেষে সহকারীর তকমা ঝেড়ে ফেলেন রাসেল ডমিঙ্গো। টি-টুয়েন্টি দলের হেড কোচ হিসেবে কারস্টেনের স্থলাভিষিক্ত হন নিউজিল্যান্ড সিরিজের ঠিক আগে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে সময় শীর্ষ পর্যায়ের ক্রিকেট না খেলে কোনো জাতীয় দলের হেড কোচ হওয়ার কীর্তি এই ডমিঙ্গো আর একই সিরিজের কিউই কোচ মাইক হেসনের ছাড়া ছিল না আর কারোই। বেশ ভালোভাবেই সে দায়িত্ব পালন করতে থাকা ডমিঙ্গোর কোচিং ক্যারিয়ারের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয় ঠিক তার পরের বছরেই। ২০১৩ সালের মে মাসে সব ফরম্যাট থেকে গ্যারি কারস্টেনের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণায় পুরো জাতীয় দলের দায়িত্বই বর্তায় ডমিঙ্গোর কাঁধে।

পরে রাসেলের চুক্তির মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ায় প্রোটিয়া বোর্ড। তাঁর অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকা এরপর ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ শেষ করে সেমিফাইনালে পৌঁছে। ২০১৭ পর্যন্ত হেড কোচের দায়িত্ব পালন করা রাসেল ডমিঙ্গো পরবর্তীতে মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে সাড়া পাননি বোর্ডের। ওটিস গিবসন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলে ডমিঙ্গো আবার ফিরে যান নিজভূমে, ঘরোয়া টি-টুয়েন্টি লিগে প্রিটোরিয়া ম্যাভেরিকসকে নিয়ে কাটান ব্যস্ত সময়। পাশাপাশি বহাল ছিলেন প্রোটিয়াদের ‘এ’ দলের কোচের পদে।

তাঁর অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে পৌঁছায়


আর দশজন প্রাক্তন ক্রিকেটারের মতো অবসরের পর খেলাটিকে ভিন্ন স্তরে নিয়ে যাবার চেষ্টা নয়, বরং পুরোদস্তুর পেশাদার এক কোচ হবার লক্ষ্য অনুসরণেই নিজেকে গড়েছেন রাসেল ডমিঙ্গো। প্রধান কোচের ভূমিকায় সাধারণত প্রাক্তন খেলোয়াড়দের সাফল্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত বলে তা ডমিঙ্গোর জন্যও সবসময় ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং—“যেহেতু শীর্ষ পর্যায়ে খেলবার কোনো শংসাপত্র আমার নেই, তাই নিশ্চিতভাবেই সেই মর্যাদাটা আমাকে অর্জন করে নিতে হতো। হয়তো এটা এভাবেই হবার কথা, তাই আমাকে সবচেয়ে কঠিন পথটি বেছে নিতে হয়েছিল আর হতে হয়েছিল খেলাটির এক মনোযোগী ছাত্র।”

সৌভাগ্যক্রমে ডমিঙ্গো সে লক্ষ্য অনুসরণে নিজেকে চেনান একেবারে শুরুতেই, আর ২০০০ সালের গোড়ার দিকে অংশ নেন মনোযোগী ছাত্র হবার জন্য আদর্শ এক আয়োজনের। তাঁকে কোচ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রোটিয়া বোর্ডের নেওয়া উদ্যোগে রাসেল শিক্ষানবিশ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ড্রেসিংরুমে সময় কাটান বব উলমার ও গ্রাহাম ফোর্ডের সাথে। সেখানে শক্ত বন্ধন গড়েন মাত্র সাতটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলে প্রায় একইরকম আড়ম্বরহীন ক্যারিয়ার কাটানো ফোর্ড ও কারস্টেনের সঙ্গে।

কোচ হিসেবে গ্রাহাম ফোর্ডকে নিজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা মনে করতেন রাসেল। দারুণ জয়ের উদযাপনে বাঁধ দেওয়া কিংবা অপ্রত্যাশিত হারে বিচলিত না হবার দীক্ষা যে তাঁর থেকেই পেয়েছিলেন। যুবদল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁকে সবসময়ই আলাদা রেখেছে অন্য যে কোনো কোচ থেকে। এমনকি ইয়োহান বোথা, রবিন পিটারসনদের মতো তারকাদের নিজ হাতে গড়েছিলেন রাসেল। নিজের অধীনে শুধু পাননি গ্রায়েম স্মিথ আর এবি ডি ভিলিয়ার্সদের।

রাসেল ডমিঙ্গো দক্ষিণ আফ্রিকার খোলনালচে পাল্টে দেবার মিশনে প্রয়োগ করেছিলেন নিজের জীবন থেকে নেওয়া সব শিক্ষা। ব্যাট-বলের লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়াও বিনয় ও পরিণতিবোধের সাহায্যে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, সেটি প্রমাণেই নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। সেই ধারায় এবার নিয়োগ পেলেন টাইগারদের হেড কোচ হিসেবে। কোচিং ইউনিটে যেখানে সাথে পাচ্ছেন নিল ম্যাকেঞ্জি, শার্ল ল্যাঙ্গাভেল্ট, রায়ান কুকের মতো অভিজ্ঞ স্বদেশীদের।

আপাতত দুই বছরের চুক্তিতে বাংলাদেশের কোচ হয়েছেন ডমিঙ্গো


দায়িত্ব পেলে পরের দিনই নেমে পড়বেন কাজে—রাসেলের এমন প্রতিশ্রুতিতে প্যাশনের আঁচ পেয়েছে বিসিবি। বোর্ডকে তেমন কোনো শর্তের বেড়াজালেও ফেলেননি বলেই তালিকার বাকি দুজনকে হটিয়ে রোডস-উত্তর বাংলাদেশ দলের গুরু নিযুক্ত হলেন কদিন বাদেই ৪৫-এ পা রাখতে যাওয়া সদা হাস্যোজ্জ্বল এই অভিজ্ঞ কোচ। শুধু জাতীয় দলই নয়, রাসেলের কর্মপরিকল্পনায় থাকবে ‘এ’ দল, হাইপারফরমেন্স এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলও। আপাতত আগামী বছর অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য আইসিসি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপকে পাখির চোখ করলেও ডমিঙ্গো প্রথম পরীক্ষায় বসছেন আসছে সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে সিরিজটি দিয়ে।

“উপমহাদেশের ক্রিকেটকে বদলে দিতে নয়, বরং এই ধারার সাথে মানিয়ে বদলে যেতে এসেছি”—রাসেল ডমিঙ্গোর এমন আশাবাদে নতুন যুগে পা রাখতে যাচ্ছে সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। জীবনে বহু চরাই-উৎরাই পার করে আসা এই দক্ষিণ আফ্রিকানের নতুন মিশনে রইল শুভকামনা।

এ সম্পর্কিত আরও খবর