অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ : আমৃত্যু প্রগতিশীল ও নীতিবান এক রাজনীতিক

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 11:58:22

নির্লোভ ও ত্যাগী এক বরেণ্য রাজনীতিকের প্রতিকৃতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। রাষ্ট্রীয় পদক ও সম্মান সবারই আরাধ্য থাকলেও জনগণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাটাই ছিল তাঁর কাছে প্রধান দায়িত্ব। তাই তো, ২০১৫ সালে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ গ্রহণ করার প্রস্তাব। তাঁর মত ছিল, “রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনো রাজনীতি করিনি। পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস করি না আমি।”

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় নিষ্ক্রিয় ও বিভক্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি ছিলেন তিনি। তবে শুধু এটুকু দিয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য ও সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনকে পরিমাপ করা যাবে না। পাকিস্তান আমলে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী এক ব্যক্তিত্ব। ২৩ আগস্ট, ২০১৯ দীর্ঘ ৯৭ বছরের কর্মময় জীবন ছেড়ে চিরপ্রস্থান করেন এই মহান নেতা।

মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আলহাজ কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মায়ের নাম আফজারুন্নেছা। বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। মোজাফফর আহমদ যথাক্রমে হোসেনতলা স্কুল ও জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশনে প্রাথমিক, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি গ্রহণ করেন এবং ইউনেস্কো থেকে লাভ করেন একটি ডিপ্লোমা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র মোজাফফর দীর্ঘদিন বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। শেষমেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। অত্যন্ত বর্ণিল তাঁর রাজনৈতিক জীবন। রাজনীতি অঙ্গনে তাঁর শুভসূচনা হয় ১৯৩৭ সালের দিকে। তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজ জেলা কুমিল্লার দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দেন রাজনীতির ময়দানের সবাইকে। আওয়ামীলীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে ন্যাপ-এর প্রতিনিধি নেতা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফর আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। এসকল কারণে, সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে ১৯৫৮ সালের দিকে। তাকে ধরিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণা পর্যন্ত করা হয়। আত্মগোপন থাকা অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুসংগঠিত করেন।

মোজাফফর আহমদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের ছয় উপদেষ্টার একজন


দীর্ঘ আট বছর সময়ব্যাপী আত্মগোপনে থাকবার পর ১৯৬৬ সালে তিনি প্রকাশ্য রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বাম রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১৯৬৭ সালের ৩০ নভেম্বর রংপুর জেলায় অনুষ্ঠিত এক কাউন্সিল অধিবেশনের পর চীনপন্থী ও মস্কোপন্থী—এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। চীনপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন মাওলানা ভাসানী এবং মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি হন সীমান্ত প্রদেশের খান আবদুল ওয়ালী খান। মস্কো শিবিরে পূর্ব পাকিস্তানপন্থী ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এ অংশ পরিচিত ছিল মোজাফফর-ন্যাপ নামেও। অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কারাবরণও করেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথা মুজিবনগর সরকার ছয় সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেছিল, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। উপদেষ্টা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফর করেন তিনি। সে সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে নিজস্ব উনিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনে অধ্যাপক আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বয়সে তিনি বঙ্গবন্ধুর দুই বছরের ছোট। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝে রসিকতা করে তিনি বলতেন, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলে আমি তো জাতির চাচা।

তবে, স্বাধীনতার পর নিরিবিলি রাজনীতি করার সুযোগ তিনি পাননি তেমনটা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে আবার আত্মগোপনে যেতে হয়। শুধুমাত্র রিক্সাভাড়া পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তিনি।

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলে তিনি ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। স্বৈরাচারী শাসক এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে অধ্যাপক আহমদ কারারুদ্ধ হন। তখন, তার স্ত্রী আমিনা আহমদ স্কুলে চাকরি করে সংসার চালাতেন।

রাজনীতি জীবনে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, দক্ষিণ ইয়েমেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের নানান দেশে সফর করেন। তাঁর সহধর্মিণী আমিনা আহমদ বর্তমানে ন্যাপের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সভানেত্রী হিসেবে আছেন বাংলাদেশ নারী সমিতিতে।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিকের মূর্ত প্রতীক। অত্যন্ত সাদাসিদে জীবনযাপন করতেন তিনি। নিজেকে তিনি সবার কাছে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’ হিসেবে। নিজে সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে রাজনীতি করলেও ধর্ম-কর্মের প্রতি বিশ্বাস ছিল তাঁর। আল্লাহর ওপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা।

বয়সের দিকে জীবনের সেঞ্চুরি তিনি পূরণ করতে পারেননি একটুর জন্য। তেমনি রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে তাঁর দেখা অনেক স্বপ্নও হয়তো পূরণ হয়নি। কিন্তু, একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে রাখা ও পালন করা তাঁর ভূমিকা দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তাঁকে চির-স্মরণীয় করে রাখবে, একথা বলাই যায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর