মানবতার মহান সেবক মহীয়সী মাদার তেরেসা

, ফিচার

শেহজাদ আমান, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:02:58

ভালোবাসার মানেই হচ্ছে শান্তির জন্য কাজ করা, ঈশ্বরের জন্য কাজ করা—বিশ্বাস করতেন তিনি। ঈশ্বরের একজন প্রতিনিধি হিসেবে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য। আলবেনিয়ায় জন্ম নিয়েও ভালোবাসা ও শান্তির বাণী বয়ে নিয়ে এসে সুদূর ভারতের কলকাতা শহরে স্থাপন করেছিলেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ’। এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সুদীর্ঘ অর্ধ-শতক পর্যন্ত মানুষকে দিয়ে গিয়েছেন সেবা, দাঁড়িয়েছেন দরিদ্র, দুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের পাশে। মানবতার সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে লাভ করেছিলেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। কিন্তু নোবেল পুরস্কার ও অন্যান্য পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত কোটি কোটি টাকাও তিনি দান করে দিয়েছিলেন মানবতার সেবায়। ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট ধরণীর বুকে আবির্ভাব ঘটেছিল এই মহীয়সী নারীর। আজ তাঁর ১০৯তম জন্মদিন।

শৈশবে মাদার তেরেসা


টেরিজার জন্মস্থান অটোমান সাম্রাজ্যের আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়ে। তাঁর পিতা-মাতা প্রদত্ত নাম মেরি তেরেসা বোঝাঝিউ। ব্যাপ্টাইজড হওয়ার পর তাঁর নাম হয় অ্যাগনেস গঞ্জা বোঝাজিউ। তবে, তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন মাদার তেরেসা নামেই। জীবনের প্রথম আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি কাটান জন্মস্থান আলবেনিয়াতে। ১৯২৮ সালে তিনি আয়ারল্যান্ড হয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে আসেন। উদ্দেশ্য খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা। তবে, তিনি শুধু খ্রিস্টের বাণী বা খ্রিস্টধর্ম প্রচারেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, যে মানবতা তাঁর কাছে ছিল ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে।

তারুণ্যে মাদার তেরেসা। তখনও খ্রিস্টান নান হিসেবে জীবন শুরু করেননি তিনি


কলকাতায় মিশনারী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেন পঞ্চাশের মন্বন্তর। ১৯৪৬-এর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাতেও মারা যায় অনেক মানুষ। এইসব ঘটনা গভীর প্রভাব বিস্তার করে তাঁর মনে।

এর পরপরই ১৯৪৮ সাল থেকে দরিদ্রদের মধ্যে মিশনারি কাজ শুরু করেন তিনি। পোশাক হিসেবে পরতে শুরু করেন নীল পাড় দেওয়া একটা সাদা শাড়ি। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কাজ শুরু করেন বস্তি ও হতদরিদ্রদের এলাকায়। স্থাপন করেন স্কুল, শুরু করেন ক্ষুধার্ত ও দুস্থদের ডাকে সাড়া দিতে। ১৯৫০ সালে প্রায় শূন্য হাতে স্থাপন করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’। কিন্তু প্রথম দিকে সেবার কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে বেশ কষ্টই করতে হয়েছিল তাকে। গরীব ও দুস্থদের সেবা দিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সংকুলানের জন্য ঘুরেছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই হতাশা, সন্দেহ ও একাকিত্বের শিকার হতে হয়েছে তাকে। মাত্র ১৩ জন সদস্য নিয়ে ‘মিশরানিজ অব চ্যারিটিজ’ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু আজ সেখানে কাজ করে প্রায় ৪,০০০ নান। চ্যারিটির অধীনে পরিচালিত হয় এতিমখানা ও এইডস আক্রান্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। বিশ্বব্যাপী শরণার্থী, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত, বয়স্ক, মাদকাসক্ত, দরিদ্র, আশ্রয়হীন এবং বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে আক্রান্তদের জন্য কাজ করে যাচ্ছে চ্যারিটির সদস্যরা।

নগর কর্তৃপক্ষের দেওয়া জমিতে ১৯৫২ সালে মুমূর্ষুদের জন্য গড়ে তোলেন আশ্রয় ও সেবাদান কেন্দ্র। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে রূপান্তরিত করেন ‘কালিঘাট হোম ফর ডাইং’-এ। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মিত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে আসা দুস্থদের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমানভাবে থাকার সুযোগ দেওয়া হতো। মুসলিমদের দেওয়া হতো কুরআন পড়া, হিন্দুদের গঙ্গাজলে স্নান করা ও ক্যাথলিকদের দেওয়া হতো লাস্ট রাইটের সুবিধা।

এর কিছুদিন পরেই কুষ্ঠরোগে আক্রান্তদের জন্য একটি সেবাকেন্দ্র খোলেন তিনি, যেটার নাম দেওয়া হয় শান্তিনগর। ‘মিশরানিজ অব চ্যারিটি’ লালন-পালন করত অনাথ ও এতিম শিশুদের। কিন্তু শিশুদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ওদের জন্য আলাদা একটা হোম প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মাদার তেরেসা। তাই, ১৯৫৫ সালে ওদের জন্য স্থাপন করা হয় ‘নির্মল ভবন’।

ধীরে ধীরে মিশনারিজ অব চ্যারিটিজ দেশি-বিদেশি অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি ও দাতা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। ১৯৬০-এর দশকে চ্যারিটির তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় ভারতের অনেক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র। ভারতের বাইরে চ্যারিটির প্রথম কেন্দ্র স্থাপিত হয় ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬৫ সালে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করছেন মাদার তেরেসা


১৯৭০-এর দশকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে অসহায় ও অসুস্থ মানুষদের একজন মহান সেবিকা হিসেবে মাদার তেরতেসার খ্যাতি। এরই ফলস্বরূপ, ১৯৭৯ সালে অর্জন করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। ১৯৮০ সালে ভারতের একজন নাগরিক হিসেবেই লাভ করেন দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ম’। পুরো আশির দশকে শান্তির একজন দূত হিসেবে ভ্রমণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার পর অবনতির দিকে যেতে থাকে তাঁর স্বাস্থ্য। ১৯৯১ সালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর আরো অবনতি ঘটতে থাকে তার হৃদরোগের। চ্যারিটির প্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। কিন্তু নানদের আপত্তি ও অনুরোধে প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। ১৯৯৬-এ শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এবং ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একেবারে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। এর কিছুদিন পরে চ্যারিটির প্রধান-এর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। অবশেষে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে ১৯৯৭-এর ৫ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন তিনি।

মানবতার জন্য অকাতরে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। কাজ করেছেন দুস্থ ও বিপদাপন্ন বাংলাদেশিদের জন্যও। মুক্তিযুদ্ধের পর শরণার্থী ও অবকাঠামো সমস্যার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা ছিল বীরাঙ্গনা সমস্যা। সমস্যাটি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা তথৈবচ। আত্মহত্যা বা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হওয়াটাই যেন ছিল তাদের সমাধান। সেই ক্রান্তিকালে মাদার তেরেসা এসেছিলেন বাংলাদেশে। ঢাকায় পাঁচটি বাসা ভাড়া করে বীরাঙ্গনাদের জন্য খুলেছিলেন আশ্রয়কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধে লাঞ্ছিতদের যথাযথ সম্মান দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাদের বীরাঙ্গনা নামে আখ্যায়িত করে ব্যবস্থা করেছিলেন বিয়ে দেওয়ারও। অনেকেই এগিয়ে এসেছিল তাদের বিয়ে করতে। অনেক বীরাঙ্গনাই সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন; সেসব সন্তানের অনেকেই আশ্রয় পেয়েছিল মাদার তেরেসার।

মাদার তেরেসার কাছে সব মানুষই ছিল ঈশ্বরের প্রতিনিধি। তাই, নিজে খ্রিস্টান নান হয়েও অকাতরে সেবা ও সাহায্য বিলিয়ে গিয়েছেন সব ধর্ম ও বর্ণের মানুষের কাছে। তাই তো আজও মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এই মহীয়সী নারীকে। মানুষ ও মানবতাকে নিয়ে তাঁর দেওয়া মহান বাণীগুলো আজও নাড়া দেয় আমাদের অন্তরকে। পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো মাদার তেরেসার অমর ও অসাধারণ কিছু উক্তি—

● ভালোবাসার কাজই শান্তির কাজ।
● একটি হাসি দিয়ে শান্তি শুরু হয়।
● আমরা ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা করি কারণ আমরা বর্তমানকে নষ্ট করছি।
● নিখুত ভালোবাসা পরিমাপ করা যায় না, এটি শুধু দেয়।
● ভালোবাসার কথাগুলো হয়তো খুব সংক্ষিপ্ত ও সহজ হতে পারে কিন্তু এর প্রতিধ্বনি কখনো শেষ হয় না।
● যদি তুমি মানুষকে বিচার করতে যাও তাহলে ভালোবাসার সময় পাবে না।
● সর্বশ্রেষ্ঠ রোগগুলির মধ্যে অন্যতম হলো কেউ কারো নয়।
● আনন্দ ভালোবাসার একটি জাল যা দ্বারা আপনি আত্মার বন্ধন গড়তে পারেন।
● তুমি যখন কারো সঙ্গে দেখা করো তখন হাসিমুখ নিয়েই তার সামনে যাও। কেননা হাস্যোজ্জ্বল মুখ হলো ভালোবাসার শুরু।
● আনন্দই প্রার্থনা, আনন্দই শক্তি, আনন্দই ভালোবাসা।
● আপনি যদি ১০০ জন লোককে খাওয়াতে না পারেন, তাহলে মাত্র একজনকে খেতে দিন।
● ভালো কাজগুলো পরস্পর সংযুক্ত যা প্রেমের শৃঙ্খলা গঠন করে।
● ছোট বিষয়ে বিশ্বস্ত হও, কারণ এর ওপরেই তোমার শক্তি নির্ভর করে।
● কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ।
● হৃদয়কে স্পর্শ করতে চায় নীরবতা। কলরবের আড়ালে নীরবেই পৌঁছাতে হয় আর্তের কাছে।
● আমি ঈশ্বরের হাতের একটি ছোট পেন্সিল যা দ্বারা ঈশ্বর পৃথিবীতে ভালোবাসার চিঠি লিখছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর