যেদিন শেষ হয়েছিল সর্বগ্রাসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

, ফিচার

শেহজাদ আমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-09-01 22:15:24

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগল বলে গুঞ্জন উঠেছে মাঝেমাঝেই। যেমনটা একসময় উঠেছিল ১৯৯১-এর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আর কোনো বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হয়নি বিশ্বকে। যদিও এখনো মাঝেমাঝে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই ছিল বিশ্বব্যাপী সর্বগ্রাসী ও ভয়াবহ শেষ যুদ্ধ। এর সমাপ্তি ঘটে টোকিও উপসাগরে জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। দিনটি ছিল ১৯৪৫-এর আজকের দিন, ২ সেপ্টেম্বর।

প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দুটোই হয়েছিল বিগত শতাব্দীতে। ভয়াবহতার দিকে থেকে আগেরটিকে নিঃসন্দেহে ছাড়িয়ে গিয়েছিল পরেরটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল প্রায় প্রায় দুই কোটি মানুষ। এক কোটির মতো মারা গিয়েছিল সামরিক লোক। আর বেসামরিক মারা গিয়েছিল প্রায় সমপরিমাণ। আহত হয়েছিল আরো দুই কোটির বেশি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল সাত থেকে আট কোটি লোক। যা ছিল পুরো পৃথিবীর সেই সময়ের জনসংখ্যার ৩%। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সামরিক লোকের প্রাণহানির সংখ্যা ছিল দুই কোটি থেকে আড়াই কোটি। আর বেসামরিক লোকের মৃত্যুর দিক থেকে তা ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংখ্যাকে। বাকি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি নিহত লোকই ছিল বেসামরিক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়াইটা ছিল সাগরে ও মাটিতে। এবং মূলত সেটি ছিল ভূমিরই লড়াই। সেই লড়াইয়ের মূল হাতিয়ার ছিল লক্ষ লক্ষ ইনফ্যান্ট্রি বা পদাতিক সৈন্য। আর তাদের পেছনে ভারী কামান। আর সাগরযুদ্ধেও কামান। কেননা নৌ যুদ্ধ ব্যাট্‌ল্‌শিপ নির্ভর। মুখোমুখি জাহাজে জাহাজে লড়াই। কামানের পাল্লার ওপর যুদ্ধের ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করত। আর যুদ্ধবিমান? সেগুলো ছিল নেহাৎই অকিঞ্চিৎকর। যুদ্ধের ফলাফলে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারত না সেই পুঁচকে আকাশচারীরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটে ভয়াবহ বিমান হামলার ◢ 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো কিন্তু যুদ্ধবিমানের হাত ধরেই। আর বোমারু বিমানের মাধ্যমে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও প্রচণ্ডতাও বেড়ে গিয়েছিল অনেক বেশি পরিমাণে। যতদিন গেছে, ততই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিমানেরা আরো অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। সাগর যুদ্ধ তো পুরোটাই বিমান নির্ভর আর স্থল যুদ্ধও হয়ে উঠল বিমানের ওপর খুব নির্ভরশীল। ইতালিয়ান সেনানায়ক গুইলিও দউহেট ও আমেরিকান বিলি মিচেল—দুজনই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বিমান যুদ্ধের তাত্ত্বিক নেতা হিসাবে খুব নাম করেন। এ দুজনই বোমারু বিমানের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁদের ধারণা ছিল বিমানবিধ্বংসী কামান যতই থাকুক না কেন, একঝাঁক বোমারু বিমান পাঠালে কয়েকটি অন্তত লক্ষ্যস্থলে ঠিকই বোমা ফেলে আসতে পারবে। সেই মতন হিসাবও কষা হতো যে, এত স্কোয়ার ফিট জায়গা চূর্ণ করতে কয়টি বিমানের দরকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে প্রায় ৮৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মাত্র ৯০০০ ছিল বোমারু বিমানের শিকার। কিন্তু এই স্ট্র্যাটেজিস্টরা তখনই ভবিষ্যতের বোমারু বিমানের প্রচণ্ড বিধ্বংসী ভূমিকা কল্পনা করতে পেরেছিলেন।

এদিকে, যুদ্ধ যতই এগিয়েছে, যুদ্ধের মিত্রশক্তি (আমেরিকা, ইংল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়ন) এবং অক্ষশক্তি (জার্মানি, জাপান ও ইতালি) একে অপরকে পরাস্ত করার জন্য খুঁজতে থাকে নতুন নতুন সমর উপকরণ ও শক্তি। একের পর এক যুদ্ধক্ষেত্রে মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজিত হতে থাকা জার্মানি আত্মসমর্পণ করে ১৯৪৫-এর ৭ মে। কিন্তু, তখনও মরণকামড় দিয়ে যাচ্ছিল জাপান। তবে, জাপানিদেরকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন স্থান থেকে। যুদ্ধ ধারণ করছিল ভয়ঙ্কর রূপ। প্রতিদিন মারা যাচ্ছিল অসংখ্য সৈন্য। একারণে আমেরিকার কাছাকাছি অবস্থানে থাকা জাপান ও চীনের মতো দেশ আক্রমণ করছিল আমেরিকাকে। সবখানেই জাপানি সৈন্যরা বিচরণ করছিল আর প্রদর্শন করছিল সীমাহীন নিষ্ঠুরতা। আত্মসমর্পণ করা মিত্রশক্তির সৈন্যদেরকে অত্যন্ত বাজেভাবে নিগৃহীত বা হত্যা করছিল জাপানিরা। জাপানি বৈমানিক যোদ্ধারা বিমান নিয়ে আত্মঘাতী হামলা বা ‘কামিকাজি’ চালাতে থাকে বিভিন্ন আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুতে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান চাইলেন জাপানি সৈন্যদের দ্রুত আত্মসমর্পণ। তাই তিনি পারমাণবিক বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে করে ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা দেখে আত্মসমর্পণ করে জাপানিরা।

আর, স্থলপথে হামলা করে জাপানিদের পরাস্ত করার সিদ্ধান্ত তারা নিতে চাইছিল না এতে প্রচুর সৈন্যের ক্ষয়ক্ষতি হবে এমন আশঙ্কায়। ২৫ লাখ সৈন্যের জাপানি সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় তাদের কমপক্ষে হারাতে হতো ২৫ হাজার সৈন্য। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ দাবি করেন, আমেরিকা চেয়েছিল জাপানিদের আত্মসমর্পণ আমেরিকার কাছেই হোক, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশের কাছে নয়। তাই তারা শেষ পর্যন্ত ফেলেই ছেড়েছিল পারমাণবিক বোমা।

পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ নিশ্চিত করে জাপানের দ্রুত আত্মসমর্পণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ◢ 


অগাস্টের ৬ তারিখে হিরোশিমায় ‘লিটল বয়, নামে এই বোমা বর্ষণের পর জাপানেরই আরেক শহর নাগাসাকিতে ৯ আগস্ট আরেকদফা পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়। পারমাণবিক বোমা যেন কেয়ামত নিয়ে এসেছিল শহর দুটিতে। পারমাণবিক বোমার সরাসরি আঘাতে সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করে কয়েক হাজার মানুষ। ধংস হয়ে যায় কয়েক বর্গ কিলোমিটারব্যাপী এলাকা।

জাপানের আসাহি শিমবুনের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট মারাত্মক শারীরিক সমস্যার কারণে দুই শহরে চার লাখের মতো মানুষ মারা যায়। এদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। নিরীহ, ঘুমন্ত অসহায় শিশু-নারী-পুরুষ, বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা ছাড়াও কয়েক লাখ মানুষ চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে।

এই ভয়াবহতা দেখে জার্মান, জাপান ও ইতালির যুদ্ধবাজরাও যেন যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলে। হামলায় দিশেহারা হয়ে পরাজয় বরণ করে জাপান, জার্মানি ও ইতালির অক্ষশক্তি। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তারা মিত্রশক্তির কাছে। ১৯৪৫-এর ১৫ আগস্ট জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। আত্মসমর্পণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২ সেপ্টেম্বর। তাই, এই দিনটিকেই ভয়াল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এই যুদ্ধের পরপরই সমগ্র ইউরোপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়; এক অংশ হয় পশ্চিম ইউরোপ আর অন্য অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়া। পরবর্তী সময়ে এই রুশ ইউনিয়নই ভেঙে অনেকগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হয় ন্যাটো আর সমগ্র ইউরোপের দেশসমূহের সীমান্তরেখা নির্ধারিত হতে শুরু করে। ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে দানা বেঁধে উঠে স্নায়ুযুদ্ধ। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বমঞ্চে অবতারণা করে অভিনব কিছু নাটকের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর