সমকামী জিনের অস্তিত্ব নেই

, ফিচার

ফিচার ডেস্ক, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম | 2023-08-31 10:53:23

সমলিঙ্গে প্রেম বা জৈবিক সম্পর্ক কি জিনগত? এতদিন তেমনটাই ধারণা করে বা জেনে আসছিলেন সেক্যুলার সমাজ ও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরা। সমকামিতার সাথে মানবজিনের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা, তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলেও চলছে অনেকদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। চলেছে বিতর্ক। কিন্তু, সম্প্রতি গবেষকরা বলছেন, সমকামিতার সাথে জিনের কোনো সম্পর্ক নেই। সমকামিতার পেছনে সামাজিক ও পারপার্শ্বিক পরিস্থিতিই দায়ী বলে উল্লেখ করেছেন তারা।

আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ও আরো কিছু সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফলে উঠে আসে এমন তথ্য। প্রায় ৫০ লাখ নারী ও পুরুষের মধ্যে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সমকামী বা গে জিন বলতে কিছু নেই। গবেষকরা সমকামী নারী ও পুরুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যে অনেক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন।

তারা জানান, সমকামিতায় অভ্যস্তদের মধ্যে ব্যক্তিগত ও মানসিক কিছু সংকট দেখা গেছে। অবসাদ, সামাজিক চাপ এসবও কাজ করে থাকে অনেক ক্ষেত্রে।

২৯ আগস্ট প্রখ্যাত একটি বিজ্ঞান জার্নালে এই ব্যাপারে প্রকাশিত হয়েছে বিস্তারিত প্রতিবেদন।

এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় উপস্থিত ছিল এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায়ের অনেকেই। তাদের কাছে এ ফলাফলটা বেশ অপ্রত্যাশিত। এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা।

তারা বলেন, এ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর অনেকে বলবে বিজ্ঞানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিকভাবে সমকামীরা আরো নাজুক অবস্থায় পড়তে পারেন বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।

এদিকে ফিনল্যান্ডের মলিকিউলার মেডিসিন, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হসপিটাল এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জিনতত্ত্ববিদরাও বলেছেন, সমকামিতা এবং জিনের মধ্যে সম্পর্ক নেই। ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) পরীক্ষার ফলাফলে তেমন চাঞ্চল্যকর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ থেকে প্রকাশিত গবেষণা ফলটি


তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৮ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ তাদের স্বভাবজাত কারণে সমকামী হয়ে থাকে।

ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের অ্যানালিটিক্যাল ও ট্রান্সলেশনাল জেনেটিক ইউনিটের গবেষক আন্দ্রে গান্না জানিয়েছেন, যে জিনকে সমকামী বলে হইচই হয়েছে, সেটি তার নির্ধারিত মাপের চেয়ে প্রায় ১০০ গুণ বেশি বড় এবং ছোট ছোট নানা জিনের সমষ্টি।

অস্ট্রেলিয়ার কুইনসল্যান্ড ইউনিভার্সিটির জিনতত্ত্ববিদ ব্র্যান্ডেন জিৎস বলেছেন, একক সমকামী জিনের অস্তিত্ব নেই। পাঁচ রকম জিনগত বৈচিত্র দেখা গেছে যেখানে সমলিঙ্গে যৌন আকর্ষণের সম্পর্ক নেই।

উল্লেখ্য, সমকামিতা এবং জিনের সম্পর্ক নিয়ে প্রথম পরীক্ষা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। ১৯৯৩ সালে আমেরিকার জিনতাত্ত্বিক ডিন হ্যামার কয়েকটি পরিবারের সমকামী পুরুষদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দাবি করেন, সমকামিতা ‘এক্স ক্রোমোজোমের’ তারতম্যের কারণে হয়।

আমাদের শরীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার অধিকাংশই জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে কিছু জিনের মুখ্য ভূমিকা থাকে যাদের বলে মার্কার (নির্দেশক)। ডিন হ্যামার ও সমকামী চিন্তার গবেষকরা সেই গবেষণার পর দাবি করেন, সমকামী পুরুষদের ১৩ এবং ১৪ নম্বর ক্রোমোজোমের মধ্যে ওই মার্কার জিনের উপস্থিতি দেখা গিয়েছে। ওই জিনই সমকামিতার জন্য দায়ী।

ওই গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় বিজ্ঞানীমহলে।

ব্রিটিশ জিনতাত্ত্বিকরা দাবি করেন, আরো অনেক, আরো বিশদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই কোনো জিনকে ‘গে জিন’ বলে চিহ্নিত করা সম্ভব। পুরুষদের ক্ষেত্রে যে জিনকে দায়ী করা হয়েছে, মহিলাদের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পৃথক হতেই পারে।

এসব তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই ‘গে জিন’ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সমকামিতা কোনো চয়েজ বা বেছে নেওয়া সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নয়, বরং শারীরিক রসায়নের বহিঃপ্রকাশ—এমন ধারণাই তখন হালে পানি পায়।

তবে, কয়েক বছর আগে আমেরিকার বিখ্যাত জন হপকিন্সের দুই বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিক প্রায় ২০০ সায়েন্টিফিক জার্নাল ঘেঁটে নিউ আটলান্টিক নামক জার্নালে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখিয়েছেন, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সাথে সহজাত, জন্মগত বা বায়োলজিক্যাল যে সম্পর্ক এতদিন ভাবা হতো, তার বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। কিছু বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর রয়েছে যার সাথে লৈঙ্গিক আচরণগত সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু সেটা কোনোমতেই সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনে ভূমিকা রাখে না। অর্থাৎ, সমকামিতা কোনোমতেই জিনগত, জন্মগত, প্রাকৃতিক বিষয় নয়।

ওদিকে, সমকামিতার জন্য ‘গে জিন’ দায়ী নয়, এমন গবেষণার ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে আবার বেশ কিছু গবেষণা করা হচ্ছে, করা হচ্ছে লেখালেখি। উঠছে তর্ক-বিতর্কের ঝড়। সমকামিতা প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক, এমন বিশ্বাস করা গবেষকেরা কথা বলছেন সেটির পক্ষে। ২৯ আগস্টই নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখিকা পাম বেলুক বলেছেন, ‘সমকামিতাকে প্রভাবিত করে শুধু গে জিনই নয়; বরং এর পেছনে আছে অন্যান্য অনেক জিনের প্রভাবও।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর