হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী : উপমহাদেশের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ

, ফিচার

শেহজাদ আমান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 21:05:38

‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ বলা হয় তাঁকে। ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। পরে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনে যাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, তাদের মধ্যে একজন—তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও সুপরিচিত, কিংবদন্তি এই রাজনীতিবিদের ১২৭তম জন্মবার্ষিকী আজ ৮ সেপ্টেম্বর।

গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে গেছেন এই মহান নেতা। সাংবিধানিক শাসনে বিশ্বাসী ও বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি এ দেশের গণসংগ্রামের ইতিহাসে সুপরিচিত। পাকিস্তানী আমলে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিভিন্ন অনাচার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় ছিলেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল তরুণ বয়সেই, গত শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। তৃতীয় দশকে এসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন রাজনীতিতে। সোহরাওয়ার্দী তাঁর গৌরবোজ্জ্বল রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনের ডেপুটি মেয়র, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনোত্তর ফজলুল হক কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৪৩-৪৫ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী, ১৯৪৬-৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪-৫৫ সালে মোহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ১৩ মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগকে বাংলায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং এর অগ্রযাত্রায় সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম ও প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরে গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের পেছনেও ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর দারুণ নেতৃত্ব।

জন্ম ও শিক্ষাজীবন

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের খ্যাতনামা বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর কনিষ্ঠ সন্তান। মা ছিলেন নামকরা উর্দু সাহিত্যিক খুজাস্তা আখতার বানু। তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন। কিন্তু, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সোহরাওয়ার্দীর টান ছিল সেই তরুণ বয়স থেকেই। সোহরাওয়ার্দী নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শেখেন এবং বাংলার চর্চা করেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর ভর্তি হন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি তাঁর মায়ের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান সোহরাওয়ার্দী। উদ্দেশ্য উচ্চতর শিক্ষা লাভ। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক অর্জন করেন। এছাড়া এখানে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে গ্রেস ইন হতে অর্জন করেন বার এট ল ডিগ্রি। এরপর ১৯২১ সালে কলকাতায় ফিরে এসে নিয়োজিত হন আইন পেশায়।

১৯২০ সালে বেগম নেওয়াজ ফাতেমার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হিন তিনি। বেগম নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের মেয়ে।

সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন (পাকিস্তান পূর্ব আমল)

১৯২২-এ স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। এটি তখন মূলত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ ছিল। ১৯২৩-এর বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরে ভালো ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা পৌরসভার ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হন। তবে ১৯২৭-এ সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯২৮ সালে সর্বভারতীয় খিলাফত সম্মেলন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলন অনুষ্ঠানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুসলমানদের মধ্যে তাঁর ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাথে তিনি জড়িত হননি। ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে তিনি ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি’ নামক দল গঠন করেন। ১৯৩৬-এর শেষের দিকে এই দলটি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাথে একীভূত হয়। এই সুবাদে তিনি বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ তথা বিপিএমএল-এর সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালের শেষ দিক পর্যন্ত এই পদে ছিলেন। ১৯৪৩ সালে শ্যমা-হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পরে গঠিত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি একজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিপুল বিজয়ে মূল কৃতিত্বের দাবিদার তিনি এবং আবুল হাশিম। ১৯৪৬ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ব্যাপক সমর্থন প্রদান করেন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ব্যাপারে কেবিনেট মিশন প্ল্যানের বিরুদ্ধে জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের আগস্ট ১৬ তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেন। বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর প্ররোচনায় এই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। মুসলমানদের জন্য আলাদা বাসভূমি পাকিস্তানের এমন দাবিতে এই দিন মুসলমানরা বিক্ষোভ করলে কলকাতায় ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেঁধে যায়। পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে এইদিন চলে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ। সোহরাওয়ার্দী এসময় তাঁর নীরব ভূমিকার জন্য হিন্দুদের নিকট ব্যাপক সমালোচিত হন। তবে, এরপর তাঁর উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে দিল্লি সম্মেলনে মুসলিম লীগের আইন প্রণেতাদের নিকট লাহোর প্রস্তাবের একটি বিতর্কিত সংশোধনী পেশ করা হয়। এই সংশোধনীতে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় তাঁর বিতর্কিত ভূমিকার কারণে হিন্দুদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া কংগ্রেসের আর কোনো নেতা তাঁর অখণ্ড বাংলার ধারণার সাথে একমত ছিলেন না। ১৯৪৭ সালে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান। তবে পদত্যাগের পর তিনি সাথে সাথে পাকিস্তান না গিয়ে কলকাতায় থেকে যান। এসময় কলকাতার মুসলমানদের সাথে হিন্দুদের পুনরায় বিরোধের আশঙ্কায় তিনি মহাত্মা গান্ধীর সাহায্য চান। মহাত্মা গান্ধী এসময় যৌথ ভূমিকার শর্তে সোহরাওয়ার্দীর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা প্রশমনের ডাকে সাড়া দেন। উল্লেখ্য, সোহরাওয়ার্দী ৪৭-এর দেশভাগের সাথে সাথে পাকিস্তানে চলে যাননি। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন ভারত সরকার তাঁর ওপর ক্রমবর্ধমান করের বোঝা চাপালে তিনি ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যেতে বাধ্য হন।

তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী


সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক জীবন (পাকিস্তান আমল)

১৯৪৭-এর আগস্টে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরে খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতারা। এর আগে ১৯৪৭ সালের আগস্ট ৫-এ খাজা নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর পরোক্ষ সমর্থনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবার পর বেশ কয়েকবার সোহরাওয়ার্দীকে “ভারতীয় এজেন্ট” এবং “পাকিস্তানের শত্রু” হিসেবে অভিহিত করেন। সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের আইনসভার সদস্য পদ থেকে অপসারিত করা হয়। তাঁর অনুসারীরা অনেকে ১৯৪৮-এর শুরুর দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং ১৯৪৯-এর জুনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও একে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কারাগারে অন্তরিন থাকা অবস্থাতেই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান মুজিব। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।

১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সাথে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাভূত করার জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এই যুক্তফ্রন্টের নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানী, একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ওই ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল—লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি।

১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩টি আসন। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মওলানা ভাসানী, আবুল কাশেম ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব জয়লাভ করে। সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। তারা শুধু নয়টি আসন লাভ করে। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এরপর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ডিসেম্বর ১৯৫৪ থেকে আগস্ট ১৯৫৫ পর্যন্ত এ পদে ছিলেন।

আগস্ট ১৯৫৫ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ পর্যন্ত পাকিস্তান আইনসভায় বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে অক্টোবর ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পররাষ্ট্র বিষয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী মনোভাবের ব্যাপারে তাকে অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত করা হয়।

১৯৫৬ সালে সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের ১৩ জন এমএনএ থাকা সত্ত্বেও রিপাবলিকান পার্টির সহযোগিতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে দারুণ কিছু উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু তাঁর এই পদক্ষেপ ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্ম দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের মতো পশ্চিম পাকিস্তানেও এক ইউনিট ধারণা প্রচলনে তাঁর চেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের কারণে নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। আগস্ট, ১৯৫৯ থেকে ইলেক্টিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশান অর্ডার অনুসারে তাকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে তাকে জানুয়ারি ৩০, ১৯৬২-তে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং করাচি সেন্ট্রাল জেলে অন্তরিন করা হয়। ১৯৬২-এর ১৯ আগস্ট মুক্তি পান তিনি। অক্টোবর, ১৯৬২-তে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে দুই পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিলে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন।

লেবাননের একটি হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন


১৯৬৩-এর ৫ ডিসেম্বর লেবাননের একটি হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজারে প্রখ্যাত এই নেতার সমাধি রয়েছে। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিবসে তাঁর সমাধিতে আজও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করে থাকে।

মহান এই নেতাকে আজও মনে রেখেছে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন যে রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিলেন তাঁর ৭-ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, সেই স্থানটিকে স্বাধীনতার পর নামকরণ করা হয় এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’ নামে পরিচিত জায়গাটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম রূপায়িত হয়েছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একজন পুরোধা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সবসময়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর