সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি 'সোনার কেল্লা' যারা দেখেছেন, তারা উত্তর ভারতীয় রাজস্থান রাজ্যের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, মরুময় প্রকৃতি ও ঊষর আবহাওয়ায় নারী-পুরুষের বহুবর্ণা পোশাকের বাহার আর উট, ময়ূরের উচ্ছলতা লক্ষ্য করে থাকবেন।
জয়সলমীর, বিকানার, যোধপুর, উদয়পুর, আজমির, কিষাণগড় মিলিয়ে রাজকীয় প্রাসাদ, পুকুর, হর্ম্যের ছড়াছড়ি রাজস্থানে।
১৭২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর, যে শহরের অন্য নাম 'পিংক সিটি অব ইন্ডিয়া'। ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জয়পুর শহর আমের এর শাসক দ্বিতীয় জয় সিংহ স্থাপন করেন। রাজা জয় সিংহ ভারতের শাসক মুঘলদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নামে একজন বিখ্যাত বাঙালি স্থপতির নিরলস পরিশ্রমে নির্মিত হয় জয়পুর, যে শহরের প্রাসাদ, ভবন ও স্থাপনায় খেলা করে উজ্জ্বল গোলাপি রঙের আভা।
প্রাসাদ ও স্থাপনার পাশাপাশি জয়পুরের খাবারের মধ্যে রাজপুত ও মুঘল রন্ধনশিল্পের প্রভাব সুস্পষ্ট। বিখ্যাত খাবার ডাল কচুরি, টিকি, বেজাত রুটি, কিমা বাটি, চুরমা, লাল মাস, মিরচো বাদাস, জঙ্গলি মাস, পনির আফতাব, সুলা বিরিয়ানি ইত্যাদি। এছাড়া রাজস্থানি স্টাইলে রান্না করা মুরগি, খাসি এবং মাছের তরকারি খুবই প্রসিদ্ধ। বিভিন্ন ধরনের ও স্বাদের বড়া, চা ও মণ্ডা মিঠাই রাজস্থানের খাদ্য ঐতিহ্যের অংশ।
ভারতের উত্তরাঞ্চলে পর্যটনের যে সোনালী ত্রিভুজ বা 'গোল্ডেন টায়াঙ্গেল' অবস্থিত, তার এক বাহু দিল্লি, দ্বিতীয় বাহু আগ্রা আর তৃতীয় বাহু জয়পুর-আজমির। ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্বঐতিহ্যের বহু স্থাপনা রয়েছে এ অঞ্চলে। ফলে দিল্লি থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জয়পুর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এখানে ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট ও অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে জন্তর মন্তর, অ্যামের (আম্বর) দুর্গ প্রাসাদ, হাওয়া মহল, অ্যালবার্ট হল মিউজিয়াম, সিটি প্যালেস ইত্যাদি।
জয়পুর ছাড়িয়ে আজমির, যোধপুর, বিকানার, উদয়পুর, জয়সলমীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। রাজস্থান পাশের গুজরাট ও পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সঙ্গে ক্রমশ পশ্চিম দিকের মরুময় সীমান্ত এলাকায় মিশেছে।
জয়পুরের গড় আবহাওয়া বেশ উষ্ণই বলা চলে। তবে অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে হাল্কা শীত থাকে। তখন তাপমাত্রা অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। জয়পুরের শীতকালও অনেক চমৎকার। এখানে শীতকাল শুরু হয় নভেম্বর থেকে আর শেষ হয় ফেব্রুয়ারিতে। এই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী লোক উৎসবের আয়োজন করা হয়। তবে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভাল বা সাহিত্য সম্মেলন বেশ নাম করেছে। মার্চে জয়পুরের বিখ্যাত হাতি উৎসব বা এলিফেন্ট ফেস্টিভাল বেশ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান।
জয়পুর প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত, পুরনো শহর আর নতুন শহর। পুরনো অংশকে পিংক সিটি বলা হয়। জয়পুরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এ এলাকাটি সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের স্থাপনা দ্বারা পরিপূর্ণ।
জয়পুরের নতুন অংশটিও একেবারে কম পুরনো নয়। উনবিংশ শতাব্দিতে রাজা রাম সিংহ শহর বর্ধনের পরিকল্পনা হাতে নেন। নতুন অংশে নাগরিকদের সুবিধার জন্য উন্নত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদি চালু করেন রাজা রাম সিংহ। এখানকার প্রাসাদগুলোতে প্রাচীন মুঘল শৈলীর সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ছাপ সুস্পষ্ট। জয়পুরে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা হাত ধরাধরি করে চলে। অতীত আর বর্তমান মিলিত সুরে কথা বলে।
ভারতের ভ্রমণ আকর্ষণের শীর্ষ নামের মধ্যে দিল্লি, আগ্রা, আজমির, জয়পুর রয়েছে সামনের কাতারে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদচারণায় সারা বছর মুখরিত এ শহরে ভ্রমণকারীদের জন্য খাদ্য, কেনাকাটা, বিনোদন, নৃত্যগীতের বাইরেও রয়েছে নানা সুযোগ।
অধুনা বিকশিত হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম, প্রত্ন পর্যটন ও হেলথ ট্যুরিজম। জয়পুরে মনিপাল, নারায়ণা, কলম্বিয়া, মানস সরোবর, ফর্টিস স্কট, অ্যাপেলোর মতো নাম করা মাল্টিস্পেশাল হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। জয়পুর-আজমিরের প্রত্ন ও আধ্যাত্মিক স্থানগুলো ভ্রমণের সময় স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো জরুরি কাজগুলোও সেরে নিচ্ছেন পর্যটকরা।