চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর একশ বছর পেরিয়ে গেছে। তার সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে আছে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। অনেকেই রীতিমতো তখতবিহীন। চেঙ্গিসের এক পুত্রের নাম চাগতাই, তার মৃত্যুর পর বংশধররা ১২২৭ সাল থেকে ১৩৬৯ সাল পর্যন্ত মধ্য এশিয়ায় শাসন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। তার নাম অনুসারেই বংশধরদের নাম হয় চাগতাই বংশ।
চাগতাইয়ের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসে তার নাতি কারা হালাকু। কিন্তু এ দফায় বেশিদিন টিকতে পারেননি। মোঙ্গল নেতা কুয়ুক খান তাকে সরিয়ে চাগতাইয়ের পঞ্চম পুত্র ইসু মসুকিকে সিংহাসনে বসান। মোঙ্গল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি কারাকোরামে স্থিত মঙ্গু খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করা হয় ইসু মসুকিকে। ফলে আবার ক্ষমতায় আসেন কারা হালাকু। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ওরগানা সাময়িকভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। সময় হলে ১২৬৬ সালে মসনদে বসেন কারা হালাকুর পুত্র মোবারক শাহ।
চাগতাইদের মধ্যে তিনিই প্রথম গ্রহণ করে ফেলেছিলেন ইসলাম ধর্ম। ফলে শাসন ব্যবস্থাতে আগাগোড়া পরিবর্তন আসে। আগেকার অভিজাত ও প্রতিষ্ঠিতদের বিষয়টা না মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক। শীঘ্রই তাকে সরিয়ে দিয়ে সামনে আসলেন চাচাত ভাই বুরাক খান। বুরাক খানের পর পুত্র দুয়া খান এবং তারও পরে দুয়া খানের তিন পুত্র ইসেন বুকা, কাবাক এবং তারমাশিরিন একের পর এক গদিতে বসেন। সর্বশেষ জনের নাম তারমাশিরিন, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আলাউদ্দীন নাম নেন।
আলাউদ্দীনের মৃত্যুর পর চাগতাই সাম্রাজ্য চরম গোলযোগে পতিত হয়। তখন চাগতাই মোঙ্গলদের সাথে তুর্কিদেরও যোগাযোগ বেড়ে গেছে। ঠিক সেই রকম এক বংশধর তরুণী তাকিনাহ খাতুন, যার বিয়ে হয়েছিল আমীর তুরঘাই নামের তুর্কি দলপতির সাথে।
আট দশটা বিয়ের মতো এই বিয়েটাও সাধারণ হতে পারত; কিন্তু হয়নি। কারণ তাদের ঘরে এমন এক সন্তান জন্ম নেয়, যার হাতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। আমৃত্যু রহস্যময় মানুষটির নাম তৈমুর; জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনায় তার বিস্ময়কর নাটকীয়তা সাহিত্যিকের কল্পনাকেও হার মানায়। শত্রু শিবিরের ধ্বংসস্তূপের ওপর তার নৃশংস উল্লাস আর একই সাথে শিল্পের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ—বিপরীত বৈশিষ্ট্য খাপ খেয়েছিল তার সাথে। শত্রুকে যুদ্ধের মাঠে রেখেই মজে থাকতে পারতেন দাবা খেলায়। ইতিহাসের অনেকেই তাকে ‘এ ম্যান অব প্যারাডক্স’ বলে ডাকতে পছন্দ করেন।
১৩৩৬ সালে মধ্য এশিয়ার কেস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আমীর তুরঘাই ছিলেন বারলাস গোত্রের গুরগান শাখার প্রধান। গুরগান শব্দের মানে গৌরবময় আর তৈমুর মানে লৌহ। নিজের জীবনে নামের অর্থ ভালোভাবেই প্রমাণ করেছেন আমীর তৈমুর গুরগান।
বাল্যকাল থেকেই তার দাপুটে স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেতে থাকে। সামরিক বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন মাত্র বারো বছর বয়সেই। পিতার মৃত্যুর পর থেকেই মূলত নানা বিপদ আর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে থাকেন। তখন ট্রান্সঅক্সিয়ানার সিংহাসন নিয়ে গোলযোগ চলছে। মঙ্গোলীয় শাসনকর্তা তুঘলক তৈমুর খানের আক্রমণের কারণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তৈমুর। সন্তুষ্ট হয়ে তুঘলক খান প্রথমে শাসক এবং পরে পুত্রের উপদেষ্টা মনোনীত করেন। কিন্তু শীঘ্রই ষড়যন্ত্রের কারণে সমরকন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।
চরম সহায়হীন অবস্থায় এক হতভাগ্যের জীবন কাটছে তখন তৈমুরের। ভাগ্যান্বেষণে কী না করেছেন? খিভার শাসনকর্তার কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি মুখে হ্যাঁ করলেও বাস্তবে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। অবস্থা বুঝতে পেরে মরুভূমিতে পলায়ন করেন তৈমুর। সময়টা ছিল আসলে তার পরীক্ষার, অন্তত ভাগ্যবিধাতা তাকে প্রস্তুত করছিলেন এভাবেই। নাহলে বিপদের পরে আরো বিপদে কেন পড়বেন? একদল তুর্কি তাকে বন্দী করলে তিনি আরো একবার কঠিন কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করলেন।
ভাগ্য বিড়ম্বিত তৈমুর এখানে-সেখানে ঘুরে ক্লান্ত। কোথাও আশার কোনো বাতি নেই। তারপরেও তিনি অধৈর্য হননি। ইতোমধ্যে সিস্তানের শাসনকর্তা জালালউদ্দীন মাহমুদ এক বিদ্রোহ দমনের জন্য তার কাছে সাহয্য প্রার্থনা করল। তিনি সাড়া দিলেন। অধিকৃত হলো বিদ্রোহীদের দূর্গ।
এত দ্রুত কি আর ভাগ্য বদলায়? দ্রুত পাল্টে গেল দাবার ছক। শত্রুরা যাবার আগে জালালউদ্দীনকে তৈমুরের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে যায়। তাছাড়া তৈমুরের সম্ভাবনা এবং ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি তাকে ভবিষ্যৎ বিপদ হিসাবে গণ্য করলেন। ফলে আক্রমণ করলেন তৈমুরকে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও পায়ে গুরুতররূপে আঘাত পান। সারাজীবন আর সেই পা ভালো হয়ে ওঠেনি। এই খোঁড়া পায়ের জন্যই তার নামের সাথে ‘লঙ’ যুক্ত হয়।
সিস্তান বিজয়ের পর তার চোখ পড়ল সাম্রাজ্য বৃদ্ধির দিকে। ধীরে ধীরে কুনদুজ থেকে কেস পর্যন্ত দখল করে আধিপত্য বৃদ্ধি করলেন তৈমুর। ততদিনে তুঘলক খানের মৃত্যু হয়ে পুত্র খাজা ইলিয়াস পরবর্তী শাসক হিসাবে সমরকন্দের গদিতে বসেছেন। সুযোগ পাওয়া মাত্রই আক্রমণ করে সমরকন্দ দখল করে নেন তৈমুর। এবার যেন পা রাখার একটা জায়গা হলো।
এতদিন এতগুলো অভিযানে তৈমুরের সাথে আরো এক ব্যক্তি সবসময় পাশে ছিলেন—আমীর হুসাইন। ক্ষমতার প্রবেশদ্বারে এসে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরল। আমীর হুসাইন সাবেক শাসনকর্তার পুত্র বলে দুজনের সমান যোগ্যতার অর্জনকেও তিনি নিজের হাতে রাখলেন। উপরন্তু বারলাস বা তৈমুরের গোত্রের ওপর কর বাড়িয়ে দিলেন। মনঃক্ষুণ্ণ তৈমুর তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকে মেনে নিলেন উদারভাবে।
সময় তো আর একরকম যায় না। হঠাৎ তৈমুরের প্রিয়তমা স্ত্রী আলজাই মৃত্যুবরণ করলেন। আলজাইয়ের আরেক পরিচয় ছিলে আমীর হুসাইনের বোন হিসাবে। মূলত আলজাইয়ের কারণে আত্মীয়তার বন্ধন হেতু এতদিন সংঘর্ষ হয়নি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা সম্ভব হলো। তৈমুর এবার ক্ষমতা হাতে নেবার জন্য সচেষ্ট হলেন।
আরো পড়ুন ➥ চেঙ্গিস খান : রহস্যময় এক বিশ্ববিজেতা
প্রথম দিকে আমীর হুসাইন মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলেন নিজের শক্তির অধিকতার কারণে। কিন্তু জাঠ বিদ্রোহ দমনের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর ব্যস্ততার দরুন শক্তি অনেকটাই ক্ষয়ে এসেছিল তার। এই সুযোগটাই নিলেন কৌশলী তৈমুর। দু্ই পক্ষের মধ্যকার সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলেন হুসাইন। দীর্ঘ হতভাগ্য জীবনের শেষে ১৩৬৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করলেন আমীর তৈমুর। রাজধানী হলো সমরকন্দ। যেন অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে সবেমাত্র ভোর হলো।
তৈমুরের বিশ্বাস ছিল—“আসমানে যেমন একজন খোদা, জমিনেও তেমনি একজন বাদশাহ থাকবে।” তাই সিংহাসন লাভের সাথে সাথেই রাজ্য বিজয়ে মনোনিবেশ করেন। মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক গোলযোগ তাকে উক্ত অঞ্চল জয় করতে প্ররোচিত করে। ১৩৬৯ সাল থেকে ১৩৮০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় জাঠ এবং খাওয়ারিজম রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন তিনি। তারপর নজর ঘুরান পারস্যের দিকে। ১৩৮০ সালে তৈমুর খোরাসান আক্রমণ করে শাসক গিয়াসউদ্দীন পীর আলিকে পরাজিত করেন। তারপর একে একে দখল করেন হেরাত, কান্দাহার এবং কাবুল। কালাত-ই নাদিরী এবং তুরশীজ নামে দুটি দুর্গ বিজয় করেন।
তৈমুরের পরের লক্ষ্য সিস্তান। সিস্তানের যুবরাজ কুতুবউদ্দীন শাহের নিকট সন্ধিপ্রস্তাব পাঠানো হলো। তারা প্রস্তাবে তেমন কোনো গুরুত্ব দিল না। বরং নতুন গজিয়ে ওঠা শাসক ভেবে আক্রমণ করে বসল। তার মাশুল গুনতে হলো শীঘ্রই। তৈমুর প্রবল প্রতাপে তাদের পরাজিত করলেন। পরাজিত সিস্তানিরা আরো বড় ভুল করল পরে রাতের অন্ধকারে আবার আক্রমণ করে। এবার তৈমুরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। শুধু বিজয় অর্জন করেই থেমে গেলেন না; নিলেন চরম প্রতিশোধ। ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা পরিণত হলো জনমানবহীন শ্মশানে। এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পি সাইক্স বলেছেন, “নগরটি এখন হিংস্র জন্তু ও পেঁচাদের আবাসে পরিণত হয়েছে।”
খোরসান ও সিস্তান বিজয় নিশ্চিত হলে তৈমুর বের হন উত্তর পারস্য বিজয়ের উদ্দেশ্যে। ১৩৮৪ সালে অতিক্রম করলেন অক্সাস নদী। দীর্ঘ একমাস অবরোধের পর দখলে এলো অস্ত্রাবাদ। নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেন রাই, মাজেনদারান, সুলতানিয়াসহ একের পর এক নগরী। এক ভাগ্য বিড়ম্বিত তরুণ থেকে এখন একটা সম্ভাবনাময় রাজ্যের অধিপতি।
কিন্তু তখনও তৈমুরের গল্পের মূল আখ্যান শুরুই হয়নি। গোল্ডেন হোর্ড থেকে অটোম্যান সুলতান অব্দি তার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে সিনেমার মতো। সেই গল্প আসবে পরবর্তী পর্বে।
● পর্ব-২ পড়তে ক্লিক করুন