পৃথিবীর সব বরফ যদি গলে যায়?

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 20:10:29

আমাদের পৃথিবীর প্রায় ৫.৮ মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা বরফে ঢাকা। একবার কি ভেবেছেন এই বিপুল পরিমাণ বরফ যদি গলতে শুরু করে তখন কী হবে? আমাদের দেশের আয়তন প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইল। পৃথিবীর বরফে ঢাকা অঞ্চলের পরিমাণ এরকম কয়েকশো দেশের চেয়েও বেশি। কী হবে যদি একদিন রাতে পৃথিবীর সব বরফ গলে যায়? সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন আপনি ভেসে আছেন জলের ওপর? কী হবে যদি আপনার দেশের অধিকাংশ ভূখণ্ড পানিতে তলিয়ে যায়? ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাত্রার যন্ত্রণা আপনি কিভাবে ভোগ করবেন?

সত্যি বলতে, বরফ গলে গেলেই যে পানি খুব বেড়ে যাবে এমন নয়। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলো বরফকে পানিতে রূপান্তরে সাহায্য করে খুব সহজে। কখনো কি একটি পানিভর্তি গ্লাসের মধ্যে একটি বরফের টুকরোকে গলে যেতে দেখেছেন? গলে যাওয়ার পর কি গ্লাসের পানির লেভেলে কোনো পরিবর্তন আসে? সত্যি বলতে কোনো পরিবর্তন হয় না। পানি যা আছে তাই থাকে। এবার একটু লবণ মিশিয়ে দেখবেন? যদি তাতে এক ঘন ইঞ্চি বরফ মেশানো হয় তবে পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে ০.০৩ ঘন ইঞ্চি। আর এটা হবে লবণাক্ত পানির কারণে। যদিও এই পানির বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ৩ % এর কম, কিন্তু চিন্তা করুন এটাই যদি কোনো বড় বরফের চাকা হয় এবং সেই বরফ গলে পড়ে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে?

কী হবে ব্যাপারটা? ভয় পাচ্ছেন? শুধু এখানেই শেষ নয়। এ তো কেবল শুরু। একটি গবেষণার ফলাফল এ ব্যাপারে আপনাকে বেশ চমকে দিতে পারে। গবেষণাটি বলে, যদি এসব বরফ গলে যায় তাহলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে প্রায় ২৩০ ফুট। যার ফলে প্রায় সাতটি মহাদেশেরই বিরাট অংশ চলে যাবে পানির নিচে। বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া কিংবা ইউরোপ আমেরিকার মতো স্বপ্নের দেশগুলোর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সমুদ্রতীরবর্তী দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া পর্যটক এবং ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের আশিভাগ বাসিন্দাই তলিয়ে যাবে পানির নিচে।

গলতে শুরু করেছে দক্ষিণ মেরুর বরফ


দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের গড়ে ৯৮ ভাগই প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু বরফাবৃত। পেঙ্গুইন, সিল, নোমাটোড, টার্ডিগ্রেডের মতো প্রবল শৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম প্রাণী এবং উদ্ভিদরাই কেবল এখানে টিকে থাকতে পারে। এক কোটি ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই বরফাবৃত অঞ্চলকে পৃথিবীর শুষ্কতম মরুভূমি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। সেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ২০০ মিলিমিটার। তবে মাঝেমধ্যেই বিজ্ঞানীরা অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া সম্পর্কে সাবধান করছেন পৃথিবীর মানুষকে। বরফ গললে কী হতে পারে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

যদি সত্যি এমনটি ঘটে তবে বর্তমানে স্থলভাগের যে মানচিত্র রয়েছে তা বদলে যাবে। ধীরে ধীরে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। কয়দিন আগেও রেকর্ড তাপমাত্রা ধারণ করা হয়েছে কুয়েতে। গত ৮ জুন দেশটিতে ছায়ায় ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও রোদে ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই এই দৌড়ে। এ বছরের ২৫ এপ্রিল ৩৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় খুলনায়। ব্যাপারটা সকলের জন্যই উদ্বেগজনক।

বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলে পৃথিবীতে থাকা পাঁচ মিলিয়ন কিউবিক মাইল বরফ গলে যাবে। আর সেই সাথে পুরো আটলান্টিক সমুদ্রতীর, এমনকি ফ্লোরিডা এবং উপসাগরীয় উপকূল তলিয়ে যাবে। নেমে আসবে এক মহাদুর্যোগ।

ভৌগোলিকভাবে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য একটু উঁচু জায়গায় থাকায় তারা হয়তো এই মহাপ্রলয় থেকে সাময়িকভাবে বেঁচে যাবে। কিন্তু তারাও বেশিদিন বাঁচতে পারবে না এই মহাদুর্যোগ থেকে। কারণ পুরো পৃথিবীই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। যারাই বেঁচে যাবে তাদেরকে অনেক ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। কেননা এই গলে যাওয়া বরফ বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড ছড়াতে থাকবে। বিপরীতে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়বে না। মানুষ শ্বাস প্রশ্বাস নিতে সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাবে।

তাহলে মানুষ কি এই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না? পারবে। কিন্তু এতে কিছুটা সময় লাগবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সময়, প্রকৃতি আপনাকে আর দেবে না। সমুদ্র তাদের গতিপথ বদলানো শুরু করবে। সমুদ্র এবং বরফ অঞ্চলের প্রাণীরা প্রবল ধ্বংসের মুখে পড়বে। যারাই বেঁচে থাকবে তাদের নিজের বাসস্থান ছেড়ে অন্যত্র জায়গা খুঁজতে হবে। প্রবল খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হবে মানুষ। সমদ্রের এই গতি পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতিও শুরু করবে বিরূপ আচরণ। মরুভূমিগুলোতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে, কিন্তু যেসবখানে আগে বেশি বৃষ্টি হতো সেসব এলাকা শুকিয়ে যাবে। কৃষি ক্ষেত্রে নেমে আসবে বিপর্যয়।

বাতাসের ধরন বদলে যাবে। আকাশে প্রচুর মেঘ জমবে এবং তা ক্রমে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে পাহাড়ের গায়ে। তৈরি হবে বন্যা। সামান্য ভূমিকম্পের কারণে নেমে আসবে ভয়াবহ সুনামি। মৃত্যু ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না মানুষের।

এসব প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই ব্রিটিশ গবেষণা কেন্দ্র ‘হ্যালি সিক্স’কে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। কেননা, কেন্দ্রটি যে বরফের ওপর তা ভেঙে যেতে পারে। ট্রাক্টর আর বুলডোজার দিয়ে কয়েক টন ওজনের মডিউলটিকে ডাঙ্গার দিকে ২৩ কিলোমিটার টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ মেরুর (কুমেরু) মাঝখান থেকেও বরফের ঢাল চলেছে উপকূলের দিকে৷ কত তাড়াতাড়ি এই বরফ সাগরে পৌঁছাবে, তা নির্ভর করবে উপকূলের শেল্ফ আইসের পাতগুলির ঘনত্ব ও অবস্থার ওপর, কেননা, এই শেল্ফ আইস হিমবাহগুলির ব্রেক হিসেবে কাজ করে।

ব্রিটিশ গবেষণা কেন্দ্র হ্যালি সিক্সকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে


হেল্মহলৎস সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড মেরিন রিসার্চের আলফ্রেড ভেগেনার ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ব্যার্নহার্ড ডিকমান বলেন, “বেশি বরফ ভেঙে গেলে পাতটা স্থিতিহীন হয়ে পড়বে, ভারসাম্য হারাবে। তার ফলে পেছনে হিমবাহের বরফ সোজা সাগরে গিয়ে পড়তে পারে। সাগরের পানির উচ্চতার জন্য একটি আইস শেল্ফ ভাঙলে ক্ষতি নেই, কেননা, বরফ জলে ভাসে। কাজেই বরফের পাত ভাঙলে সাগরের পানি বাড়বে না। কিন্তু মেরুপ্রদেশের ভিতর থেকে যে বরফ আসছে, তার ফলে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে বৈকি।”

যে কুমেরু উপদ্বীপের ওপর এই বরফের পাতগুলো অবস্থিত, সেই এলাকাটি বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু আরো শীতল এলাকাগুলোতেও বরফ গলছে। এর মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন বলে অনেক গবেষকের ধারণা। জলবায়ু পরিবর্তন দুভাবে মেরুপ্রদেশের বরফের ক্ষতি করছে। কুমেরুর পশ্চিমাঞ্চলে উষ্ণ জলের স্রোত তলা থেকে বরফ গলাচ্ছে। শেল্ফ আইসের বরফের পাতগুলোর উপরের বরফ গরম বাতাসে গলে জলের কুণ্ড তৈরি হচ্ছে।

পুড়ছে আমাজন


জলবায়ু পরিবর্তন এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে বিশব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাছে। অন্যদিকে মানুষ লোভের বশে একের পর এক বন জঙ্গল উজাড় করে যাচ্ছে। এই কয়দিন আগে বিশ্বের ফুসফুসখ্যাত আমাজনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে গেছে হাজার হাজার গাছ। এবছরই আমাজনে ৭২,৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে, ২০১৩ সালের পর এরকম ভয়ানক পরিস্থিতি আমাজনে আর তৈরি হয়নি। এই আগুন লাগার ঘটনা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৮৩ শতাংশ বেশি। আর গত এক শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে আমাজন রেইন ফরেস্টের ২০ শতাংশেরও বেশি ধ্বংস করে ফেলেছি আমরা। সোনার খনি খোঁজা, মাটি খনন ও বৃক্ষনিধনে এই রেইনফরেস্টের ২০% ব্যবহার করা হয়েছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে আমাজনের ২৭ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

সৌভাগ্যক্রমে সব বরফ একই রাতে হয়তো গলবে না। কিন্তু ধীরে ধীরে বরফ কিন্তু গলে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলেই আগামী পাঁচ হাজার বছরের মধ্যে পৃথিবী বরফহীন হয়ে যাবে। ডুবে যাবে পুরো পৃথিবী। আর তা ঘটবে আমাদেরই কারণে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর