সাহিত্যের প্রয়োজনে জন্ম নেওয়া কয়েকটি কৃত্রিম ভাষা

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 15:27:36

পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক ভাষা। হচ্ছে এবং এভাবে চলতে থাকলে আরো অনেক ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভাষার এই উত্থান-পতনের গল্প পুরোটাই প্রাকৃতিক। অনেকটা সভ্যতার মতোই। কিন্তু তাই বলে মানুষের চিরায়ত কৌতূহল থেমে থাকেনি। নিজের মনের ভাব বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ রাখার জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে নানা সংকেত। কারো কাছে আবার তা আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে জন্ম নিয়েছে সম্পূর্ণ মৌলিক ভাষা।

হাল আমলে টেলিভিশন কিংবা বইয়ের গল্পের প্রয়োজনে প্রায়ই বিভিন্ন কৃত্রিম ভাষার দেখা মেলে। তাদের বেশির ভাগই অর্থহীন ধ্বনি কপচানোতে পরিণত হয়েছে। তবে, বাস্তবিক অর্থেই কয়েকটি কৃত্রিম ভাষা আবিষ্কৃত হয়েছে; যাদের বৈশিষ্ট্য ও কার্যাবলি জীবিত ভাষার সদৃশ। কোনো কোনো ভাষার আবার রীতিমতো বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতগোষ্ঠীও তৈরি হয়ে গেছে। সাহিত্যিকদের হাত ধরে জন্ম নেওয়া সেইসব কৃত্রিম ভাষা নিয়েই আমাদের আজকের গল্প।

এলিয়েনিজ : ফিউচারামা

এলিয়েনদের ভাষা হিসাবে আবিষ্কৃত এলিয়েনিজ খুব সম্ভবত সবথেকে সহজ ভাষা। অবশ্য তার জন্য গণিতে ধারণা থাকতে হবে। ফিউচারামা নামের এনিমেটেডে সিরিজে ভাষাটা ব্যবহার করা হয়েছে। ইংরেজির সাথে খাপ খাইয়ে ২৬টি চিহ্নের প্রবর্তন করা হয় প্রথমে। ভক্তেরা তাকে সাদরে গ্রহণ করলে আরেকটু এগিয়ে দ্বিতীয় রূপটাতে প্রবেশ করা হয় গাণিতিক বিশ্লেষণের সহযোগে।

এলিয়েনিজ লিপির জন্ম হয় এলিয়েনদের ভাষা হিসাবে


প্রতিটি প্রতীকের একটা সংখ্যাগত মান আছে এখানে। যে কোনো সংবাদ প্রেরণ করা হয় এর মধ্য থেকেই। অর্থ বের করতে হলে—প্রথমে প্রতিটি প্রতীককে সরাসরি অনুবাদ করে ফেলা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলতে গেলে 0 = A, 1= B ইত্যাদি। তারপর পরবর্তী বর্ণগুলোকে অনুবাদ করা হয় পূর্ববর্তী প্রতীকের মান দেখে। তবে যদি মান শূন্যের চেয়ে ছোট হয়; তবে ২৬ যোগ করতে হবে।

ল্যাপিন : ওয়াটারশিপ ডাউন

রিচার্ড এডামস্ ১৯৭২ সালে তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘ওয়াটারশিপ ডাউন’ রচনা করেন। রচনার অন্যতম আকর্ষণ খরগোশকে দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলানো। ফরাসি শব্দ ল্যাপিন-এর অর্থ খরগোশ; মাঝে মাঝে খরগোশ সমাজ বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৬ সালে লেখকের পরবর্তী সিকুয়েল ‘টেইলস ফ্রম ওয়াটারশিপ ডাউন’-এও ভাষাটাকে অকপটে সামনে আনা হয়েছে।

রিচার্ড এডামস্ এবং তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপ


রিচার্ড এডামস্ মাত্র কয়েক ডজন শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার লেখায়। কিন্তু পরবর্তীতে তার সমর্থকেরা একে পৃথক ব্যকরণ এবং শব্দভাণ্ডারসহ কার্যকরী এক ভাষাতে পরিণত করে। 

“Os e layth Frithyeer hyaones, on layth zayn yayn dahloil.”—প্রচণ্ড রোদ পড়েছে আজ। আমরা ফুল খুঁজতে বের হব।

না’ভি : অ্যাভাটার

বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরুন তার সৃষ্টিশীলতার নজির অনেক আগেই রেখেছেন। ২০০৯ সালে অ্যাভাটার ছিল সেই তকমাকে আজীবনের জন্য পাকাপোক্ত করা। সিনেমাটিতে একটা আলাদা জাতি না’ভিকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে একটা স্বতন্ত্র ভাষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

নীল বর্ণের এই জাতির স্বাতন্ত্র্যকে আরো বাস্তবতা দিতে সৃষ্টি করা হয় না’ভি ভাষা


সঠিক সময়ে তাকে সাহায্য করেন ভাষাবিজ্ঞানী বন্ধুবর পল ফ্রমার। তিনি বিস্তৃত শব্দভাণ্ডার আর ব্যকরণের মধ্যদিয়ে জন্ম দিলেন নতুন এক প্রকাশভঙ্গির। আর দর্শক-ভক্তরাও দ্রুত তা গ্রহণ করল। পল ফ্রমারের সহযোগিতাতেই ভাষাটির আরো অগ্রগতি সাধন করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়—“Fayvrrtep fìtsenge lu kxanì. Fìpoti oel tspìyang, fte tìkenong liyevu aylaru.”—দানব এখানে নিষিদ্ধ। আমি একে খুন করব পরবর্তীদের শিক্ষা দেবার জন্য।

ডথরাকি : গেইম অব থ্রোনস

জর্জ আর আর মার্টিন তার বেস্টসেলার মহাকাব্যিক আখ্যান ‘এ সং অব আইস এন্ড ফায়ারস্’-এ অশ্বারোহী যাযাবার গোষ্ঠী ডথরাকির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বইটাতে মার্টিন অল্প কিছু শব্দও উল্লেখ করেন তাদের ব্যবহৃত ভাষার। কিন্তু পরবর্তীতে এইচভিও টেলিভিশন সিরিজ ‘গেইম অব থ্রোনস’-এ ডেভিড পিটারসন কয়েকটি শব্দ থেকে একটি স্বতন্ত্র ভাষাকেই বের করে আনেন।

ডেভিড পিটারসনের চেষ্টায় পরিণত হয় এক পৃথক ভাষা ◢


যেহেতু ডথরাকিদের বেশিরভাগ সময় কাটে ঘোড়ার পিঠে; তাই ভাষার সাথে ঘোড়ায় ওঠা ও নামার ব্যাপারটাই বেশি সম্পর্কিত। টিভি সিরিজে অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের উচ্চারণ দুর্দান্ত ছিল। আর একারণেই দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ভাষা। তারাও শিখে ফেলে—“Hash yer dothrae chek asshekh?”—কেমন হলো আজকে ঘোড়ায় যাত্রা?

ক্লিনগন : স্টার ট্রেক

সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিকশনাল ভাষার মধ্যে অন্যতম ক্লিনগন। ভাষাবিজ্ঞানী মার্ক ওকরান্ড বিখ্যাত টেলিভিশন শোতে ক্লিনগন জাতির বিশেষ প্রকার ভাষাকে সামনে আনেন। ওকরান্ড বেশকিছু বইও প্রকাশ করেন এই ভাষাকে সামনে রেখে। ক্লিনগন ভাষা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত একটা সংস্থা পাক্ষিক জার্নালও প্রকাশ করে একে উৎসর্গ করে।

ক্লিনগন লিপির দৌরাত্ম এতটাই যে; প্রকাশিত হয় জার্নাল


ভক্তেরা পরবর্তী সময়ে বিয়ের উৎসব সঞ্চালনা এবং গান লেখাতে এই ভাষার ব্যবহার করতে শুরু করে। পরিস্থিতি এতটাই এগিয়ে যায় যে, শেক্সপিয়ারের নাটক হেমলেট পর্যন্ত লিখিত হয় ক্লিনগন ভাষায়। প্রায়শ ভাষাটি ইংরেজিতে বর্ণান্তকরণ করে লেখা হয়। যেমন—“nuqDaq oH puchpa e”—বা বাথরুমটি কোথায়?

এলভিশ : জে আর আর টলকিনের রচনাবলি

জে আর আর টলকিন ছিলেন একজন বিচক্ষণ ভাষাতাত্ত্বিক এবং অভিধানকার। কোনো বিখ্যাত লেখা শুরু করার আগেই তিনি একটি ভাষা সৃষ্টি করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালান। দিনশেষে অভাবনীয় সফলতা এসে ধরা দেয়। ‘হবিট’ এবং ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ রচনার ক্ষেত্রে সেই ভাষা ব্যবহৃত হয় এলভ্-জাতির ভাষা হিসাবে। ভাষাও পরিচিতি পায় এলভিশ নামে।

কৃত্রিম ভাষাগুলোর মধ্যে সবথেকে সফল এলভিশ


পরবর্তীকালে দারুণ জনপ্রিয়তায় গ্রহণযোগ্যতা পায় ভাষাটি। পাঠক ও ভক্তদের কাছে ভাষাটা দুটি গঠনে গৃহীত হয়েছে। প্রথমত, কুয়েনইয়া বা উচ্চ এলভিশ আর দ্বিতীয়ত সিনডারিন। উভয়েই গড়ে উঠেছে ফিনিশ (ফিনল্যান্ডের ভাষা) এবং ওয়েলশ্ (ওয়েলসের ভাষা) এর ওপর ভিত্তি করে। টলকিন এই দুটি ভাষা নিয়েই গবেষণা করেছিলেন। আবার জন্ম নেওয়া ভাষার রূপ দুটোকে বিভিন্ন উপভাষায় বিভাজন করা যায়। এলভিশ বর্ণলিপির মধ্যেও আছে বেশ কিছু পার্থক্য। তাদের একটা দেখা যায় ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ সিনেমাতে ঠিক রিংটার গায়ে। উদাহরণ স্বরূপ—“Elen síla lumenn’ omentielvo”—বা একটি নক্ষত্র আলো দেয় আমাদের মিলন মুহূর্তে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর