বিস্তৃত তিতাসের বুকচিরে কিছু দূর এগোলেই ‘সাহারপাড়া’ গ্রাম। গ্রামটির কেন্দ্রে বেশ বড়সড় একটা দীঘি। দীঘির চারপাশে শ’খানেক পরিবারের বসবাস। দীঘি পাড়ে শ’খানেক পরিবার, প্রাইমারি স্কুল, মাদরাসা, মসজিদ নিয়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার একটি গ্রাম এই ‘সাহারপাড়া’। পাঁচ দশটি গ্রামের মতই সাধারণ একটি গ্রাম। তবে জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার এগোলেই তিতাস পাড়ের এ গ্রামটিতে নজর কাড়ে একটি পাঠাগার। ১৫ বছর আগে শিক্ষানুরাগী গ্রামবাসী ও স্থানীয় তরুণরা গড়ে তোলেন ‘জাহানারা বেগম ‘গণগ্রন্থাগার’। জ্ঞানের দরজা প্রসারের জন্য প্রায় ১৫ হাজার বইয়ের সমাহার রয়েছে এখানে।
শিশু কিশোরদের বই থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনা সমগ্র, জীবনী, ছোট গল্প, কবিতা, ভাষাতত্ত্ব, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ-বিদেশি বইসহ সাহিত্যের প্রায় সকল শাখার বই রয়েছে এই পাঠাগারে। পছন্দের বই সহজে খুঁজে পেতে ক্যাটাগরি অনুযায়ী আলাদা আলাদা আলমারিতে সাজানো হয়েছে এ সকল বই।
দীঘির পশ্চিম পাড়ের এক কোনে প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের পর ছোট একটা খেলার মাঠ। মাঠ পেরোলেই চোখে পড়বে দোতালা একটি ভবন। ভবনের নিচতালায় মসজিদ, উপরের তলায় এই পাঠাগার। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই বোঝা যায় পরম মমতায় আর যত্নে গড়ে তোলা হয়েছে এই গ্রন্থাগার। সিঁড়ির কাছে পাঠাগারের নামফলক, সেখানে লেখা ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই, ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিয়েছে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’।
২০০৪ সালে পাঠাগারের যাত্রা শুরু হওয়ার পর সকাল দশটা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সপ্তাহের ৬ দিন পাঠকদের জন্য নিয়মিত খোলা থাকে। শিশু কিশোরদের জন্য বই রাখা হয়েছে গ্রন্থাগারের এক দিকে। পাঠকরা যাতে এখানে বসে পড়তে পারে তার জন্য এক পাশে রাখা হয়েছে কয়েকটি টেবিল ও চেয়ার। পড়ার জন্য সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে ছোট ছোট করে দেওয়া হয়েছে কিছু নির্দেশনা। এসব নির্দেশনার কিছু ঝুলছে দেয়ালে, কিছু রাখা হয়েছে টেবিলের উপর। পাঠাগারে নিয়মিত রাখা হয় কয়েকটি পত্রিকা। মাস শেষে পুরাতন পত্রিকা বই আকারে বাধিয়ে সংগ্রহ করা হয়। এক পাশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কয়েক বছরের পুরনো পত্রিকা।
লাইব্রেরিয়ান জলি আক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে প্রতিদিনই মানুষ আসছে। কেউ বই পড়তে আসে আবার কেই শুধু ঘুরতে আসে। তবে এক সময় অনেক মানুষ আসলেও এখন তুলনামূলকভাবে একটু কম আসে। তারপরও ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষ প্রতিদিনই আসছে।
তিনি আরো বলেন, পাশেই প্রাইমারি স্কুল হওয়াতে ছোট শিক্ষার্থীরাও আসছে নিয়মিত। বইয়ের সাথে তাদের পরিচয় ঘটছে।
পাঠাগারকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য এখানে আসা পাঠকদের মতামত নেওয়া হয়। পছন্দের বই না থাকলে মতামতের খাতায় পছন্দের বইয়ের নাম লিখে যায় পাঠকরা। পরে পাঠকদের চাহিদা বিবেচনা করে বইয়ের সংগ্রহ করে থাকেন পাঠাগারের উদ্যোক্তারা।
মতামতের খাতা দেখতে গেলে দেখা যায় অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী জান্নাতুল ইসলাম বৃষ্টি লিখেছেন, আমি অনেক খুশি যে আমাদের গ্রামে এত সুন্দর একটা পাঠাগার আছে। লাইব্রেরি হলো জ্ঞানের আঁধার, এটি আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। এখানে নিয়মিত পত্রিকা আসে। কিন্তু আমি আরো বেশি খুশি হতাম যদি বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা ও ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনী বইটি থাকত ।
সাহারপাড়া গ্রামের তৌহিদুল সরকার পাঠাগারের বিষয়ে জানান, পাঠাগারে কোন ধরনের সদস্য পদ নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, যে কেউ এখানে এসে পড়তে পারে। আগে এক সপ্তাহের জন্য বই বাড়ি নিয়ে পড়ার ব্যবস্থা থাকলেও এখন এই নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। কারণ হিসাবে তিনি জানান, অনেকেই বই নেওয়ার পর ফেরত দেয় না। এক সময় ১৫ হাজারের মত বই থাকলেও এখন বারো হাজারের মত বই আছে বাকিগুলো হারিয়ে গেছে।
পাঠাগারের প্রধান উদ্যোক্তা মাসুদুর রাহমান বলেন, ছোট সময় থেকে বই পড়ার প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়া শুরু করি। তাপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার এক পর্যায়ে অনেক বইয়ের সংগ্রহ হয়ে যায়। নিজের সংগ্রহের বই দিয়েই পাঠাগারের যাত্রা শুরু করি প্রথম। ধাপে ধাপে এগোতে থাকে কাজ। গ্রামের সবাই সহযোগিতা করতে থাকেন, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পাঠাগার। অর্থায়নে এগিয়ে আসেন হাফেজ মোহাম্মদ এনায়েত ভূঁইয়া।
মূলত গ্রামের মানুষ বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা যাতে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটাতে পারেন। আদর্শিক মানুষ হতে পারেন। এ চিন্তাভাবনা থেকেই পাঠাগার দেওয়ার উদ্যোগ নেন মাসুদুর রাহমান।
পাঠাগারের আনুষ্ঠানিক পথ চলা ১৫ বছর হলেও এর যাত্রা শুরু ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে। তবে সেটাকে সঠিক অর্থে পাঠাগার বলা চলে না। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সাহারপাড়া গ্রামে শিক্ষার জন্য এসময়ের মত কোন ব্যবস্থা ছিল না। স্কুল বা মাদরাসাও ছিল না। তবে থেমে থাকেনি শিক্ষা। এ গ্রামের বউ হয়ে আসেন জাহানারা বেগম। শিক্ষা অনুরাগী জাহানারা বেগমের হাত ধরে আলোকিত হতে থাকে এ গ্রামের মানুষ। কোন ধরনের পারিশ্রমিক না নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে গ্রামের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিজের বাড়িতে ডেকে এনে ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা দিতেন তিনি। কখনো বাচ্চাদের বাড়িতে যেয়ে পড়াতেন। কখনো খেলার মাঠ থেকে বাচ্চাদের ডেকে নিজের বাড়িতে এনে পড়াতেন।
শিক্ষার প্রতি গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে থাকেন জাহানারা বেগম। সে সময় তিনি যে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিলেন তার কথা ভুলেননি সাহাড়পাড়া গ্রামবাসী। তার নাম অনুসারে পাঠাগারের নাম রাখেন ‘জাহানারা বেগম গণগ্রন্থাগার’।