বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাফল্য ও আদ্যোপান্ত

, ফিচার

সাফাত জামিল, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 22:05:58

তিন-তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে হারের স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশের নামের পাশে কিন্তু রয়েছে চ্যাম্পিয়নের তকমা। তবে সাকিব-তামিমদের টাইগার বাহিনী নয়, বিজয়ের এই মুকুট এসেছিল সালমা-রুমানাদের ‘টাইগ্রেস বাহিনীর’ হাত ধরে। বলা হচ্ছে প্রমীলা ক্রিকেটে এশিয়ার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের কথা—ব্যাট-বলের লড়াইয়ে ছেলেদের পারফরমেন্সের সাথে যারা পাল্লা দিয়ে চলছেন প্রায় সমানতালে।

১২ বছর আগে ব্যাংককে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা পড়ে এদেশের নারী ক্রিকেট দলের। প্রথম দুই ম্যাচেই জয়ের তৃপ্তি নিয়ে টাইগ্রেস বাহিনী সেবছরই এসিসি নারী টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে জিতে নেয় শিরোপা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সালমা খাতুনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দলকে। তবে ২০১১ সালে কোচ মমতা মাবেনের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন করে টাইগ্রেসরা। সেবার নিজেদের মাটিতে আয়োজিত নারী বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ৫ম স্থানে থেকে শেষ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাওয়া ৯ উইকেটের জয়ের মধ্যদিয়ে নেদারল্যান্ডসকে হটিয়ে বাংলাদেশ দল প্রথমবারের মতো লাভ করে ওয়ানডে স্ট্যাটাস।

বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে শীর্ষ দশে প্রবেশ করা বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল এরপর দ্বিপাক্ষিক এবং ত্রিদেশীয় সিরিজ মিলিয়ে ওডিআই খেলেছে সর্বমোট ৩৬টি। তাতে সফলতার মুখ দেখা গেছে মোটে ৮ বার, আর ফলাফলশূন্য রয়ে গেছে দুটি ম্যাচ। র‌্যাংকিংয়ের নয় নম্বর অবস্থানেও বেশিবার পরিবর্তন আসেনি। তবে বাঘিনীদের গর্জন টের পাওয়া গেছে বর্তমান ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ও জনপ্রিয় সংস্করণ টি-টুয়েন্টিতে। ৬৬ ম্যাচে ২৫ জয়ের পরিসংখ্যান খুব একটা আহামরি না হলেও একসময় আইসিসি টি-টুয়েন্টি র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান ছিল টাইগ্রেসদেরই দখলে।

২০১৭ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে বাংলাদেশ


এখন পর্যন্ত ওডিআই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণে ব্যর্থ বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল এরই মধ্যে খেলে ফেলেছে তিনটি টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ। এ সংস্করণের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে দুইবার। এছাড়াও চলতি বছর নিজেদের ৮ টি-টুয়েন্টির সবকটিতেই জয়ের মুখ দেখেছে জাহানারা-খাদিজাদের দল। এশিয়ান গেমসেও সাফল্যের ভারী পাল্লা রয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের—২০১০ ও ২০১৪ আসরে তাঁদের ঝুলিতে গেছে রৌপ্যপদক।

ফিরে যাই এশিয়া কাপের আলোচনায়। ২০১২ সালে ঘরের মাটিতে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হারা সাকিব-তামিমরা পরের দুই ফাইনালে হারে ভারতের কাছে। তবে সেই ভারতের মেয়েদের হারিয়েই ২০১৮ সালে এশিয়ার ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বাঘিনীরা। কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত এ প্রমীলা টুর্নামেন্টের সপ্তম আসরে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্বাগতিক মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এবং থাইল্যান্ড। কোচ অঞ্জু জৈনের অধীনে বিধ্বংসী হয়ে ওঠা বাংলাদেশ সেমিফাইনালে স্বাগতিকদের ৭০ রানে হারিয়ে প্রথমবার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আগের সবগুলো আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারতের। গ্রুপ পর্বেও ভারতকে হারিয়ে আসার পর রুদ্ধশাস ফাইনালে তিন উইকেটের জয়ে ভারতের পর একমাত্র দল হিসেবে এশিয়া কাপ ঘরে তোলে সালমা-জাহানারারা।

ভারতের পর একমাত্র দল হিসেবে প্রমীলা এশিয়া কাপ জেতে বাংলাদেশ


টাইগ্রেসদের বর্তমান কোচিং স্টাফে হেড কোচ অঞ্জু জৈন ছাড়াও আছেন আরও দুই ভারতীয়—সহকারী কোচ দেবিকা পালশিকর আর ফিজিও অনুজা দলবি। তাঁদের মিলিত প্রচেষ্টায় ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংসহ সব জায়গাতেই উন্নতির ছোঁয়া পেয়েছে বাংলাদেশ দল। শুধু জাতীয় দলই নয়, দারুণ গতিতে ছুটছে নারীদের ইমার্জিং ক্রিকেট দলও। মাস দুয়েক আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নিয়েছে তারা।

এছাড়া ব্যক্তিগত অনেক সাফল্য এসেছে গত দুই বছরে। একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে ওডিআই হ্যাটট্রিকের অধিকারী রুমানা আহমেদ জায়গা পেয়েছিলেন ২০১৮ সালের আইসিসি বর্ষসেরা টি-টুয়েন্টি দলে, সাথে পান বিশেষ ‘টিম অব দি ইয়ার’ ক্যাপ। আর আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অনবদ্য পারফর্মেন্সের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এবছরের ভারতীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ—উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জে ডাক পেয়েছিলেন অলরাউন্ডার জাহানারা আলম। ভেলোসিটি দলের হয়ে অভিষেকও ঘটে তার।

ক্রিকেটপাড়ায় ঝড় তুলছে নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের বেতন ও ভাতার বৈষম্যের বিষয়টি


তবে এমন সব অর্জনের পরও ক্রিকেটপাড়ায় নিয়ত ঝড় তুলছে এদেশের নারী ও পুরুষ ক্রিকেটারদের মধ্যকার বেতন ও ভাতার বৈষম্যের বিষয়টি। বিশেষ করে ছেলেদের ছাপিয়ে মেয়েদের এশিয়া কাপ জেতার পরপরই আলোচনায় এসেছে এই বৈষম্যের চিত্র—যেখানে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলকে দুই কোটি টাকা ও প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার দেবার ঘোষণা দেয় বিসিবি। নারী দলের চুক্তিবদ্ধ ১৭ ক্রিকেটারের বেতন যেখানে মাত্র ত্রিশ হাজার, সেখানে ছেলেদের দলে সর্বনিম্ন বেতনও প্রায় এক লাখ টাকা। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে পার্থক্যটা আরো চোখে পড়ার মতো—ছেলেদের ২৫-৩০ হাজার টাকা ম্যাচ ফি’র বিপরীতে মেয়েরা পান মোটে ৬০০!

অন্যদিকে খেলোয়াড়েরা মনে করছেন, বর্তমান সময়ের এ সাফল্যগুলো একটি সুন্দর ভবিষ্যতের ভিত হিসেবে কাজ করবে। আগামীর নারী ক্রিকেটারদের ব্যাপক সুযোগ সুবিধার পথ তৈরি করে দিতে আত্মোৎসর্গে দ্বিধা নেই সালমা খাতুনের। আর উইকেটকিপার নিগার সুলতানা মনে করেন, অবহেলিত নারী ক্রিকেটে মিডিয়ার ফোকাস ব্যাপকভাবে আসাটা জরুরি। তবে রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব হবে দলের ধারাবাহিক সাফল্যের মাধ্যমে, এমনটাই বিশ্বাস করেন তিনি।

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জে ডাক পেয়েছিলেন জাহানারা আলম


সদ্য সমাপ্ত ২০২০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ফাইনাল ম্যাচে থাইল্যান্ডকে হারিয়ে চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করা সালমা খাতুনের টাইগ্রেস বাহিনী ‘এ’ গ্রুপে লড়বে স্বাগতিক ও বর্তমান শিরোপাধারী অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলংকা এবং ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতের বিপক্ষে বাঘিনীদের প্রথম ম্যাচটি হবে পার্থের ঐতিহাসিক ওয়াকা ক্রিকেট গ্রাউন্ডে—যেখানে এখন পর্যন্ত খেলা হয়নি বাংলাদেশের পুরুষ বা নারী কোনো ক্রিকেট দলেরই। তবে তার আগে আগামী মাসের শেষে দুই সপ্তাহের সফরে পাকিস্তান যাবে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। তিন ম্যাচের টি-টুয়েন্টি সিরিজের পাশাপাশি থাকছে দুই ওয়ানডের আয়োজন।

আসন্ন টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এসব টুকরো অর্জন নিয়েই সম্ভাবনায় বুক বাঁধছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল আর বিসিবি। দলের তারকা খেলোয়াড়দের বয়সও হয়ে গেছে প্রায় ত্রিশ, তাই বিশ্বমঞ্চে দেশের সামর্থ্য প্রমাণ করতে ২০২০ সালের আসরকেই টার্গেট করে এগোচ্ছে লেডি টাইগাররা। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বাংলাদেশ দল—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

এ সম্পর্কিত আরও খবর