ক্লারা জেটকিন ও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, দুই বাতিঘর

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 00:44:16

ক্লারা জেটকিন

ক্লারা জেটকিনের জন্ম ১৮৫৭ সালে জার্মানিতে। কিন্তু ১৯৩৩ সালে তিনি স্থায়ীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। এর আগে ১৯২০ সালে তিনি লেনিনের একটি সাক্ষাৎকার নেন, লেনিন তখন অক্টোবর বিপ্লবের নায়ক। লেনিনকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পাসপোর্ট লাগবে কেন? সব দেশেই তো মানুষ বাস করে। মানুষের জগতে ভিন্ন ভিন্ন দেশ কেন?” লেনিন তার কথায় খুশি হয়ে বলেছিলেন, “আমরা যৌথ খামারের (এক বিশ্ব এক দেশ) স্বপ্ন দেখি।”

ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মান মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের নেত্রী। শৈশবে চাইতেন শিক্ষক হতে। তার বাবা ছিলেন গটফ্রাইড আইজেনার শিক্ষক। কিন্তু পড়াশোনা শেষে উপলদ্ধি করেন বছরের পর বছর একই সিলেবাস পড়ানো হয়। সরকার সুনাগরিক হওয়ার জন্য যেমন সিলেবাস চায় তাই পড়ানো হয়। কিন্তু তিনি তো এসব প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধী। তাই শিক্ষক না হয়ে ১৮৭৮ সালে তিনি যোগ দেন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে। এসময় রোজা লুক্সেমবার্গের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ক্লারা জেটকিন ও রোজা লুক্সেমবার্গ ◢


১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলন হয় কোপেনহেগেন শহরে। এ সভায় ১৭টি দেশের শতাধিক নারী-প্রতিনিধি যোগ দেন। এই সম্মেলনে ক্লারা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি খসড়া প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবে তিনি বলেন, প্রতিবছর একই দিনে প্রত্যেকটি দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করতে হবে। একই সাথে ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ নিজে পালন করেন। ক্লারা ইকুয়ালিটি নামের নারী বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এরপর থেকে এদিনে নারী দিবস পালন করা হয়।

ক্লারা জেটকিন ও ওসিপি জেটকিন


ক্লারা ১৮৮২ সালে রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা মার্কসবাদী বিপ্লবী ওসিপি জেটকিনকে বিয়ে করেন। ১৮৮৯ সালে ওসিপি মারা যান। সে সময় এক আড্ডায় বান্ধবী রোজা লুক্সেমবার্গকে বলেছিলেন, “ওসিপি আমার কাছে আয়নার মতোন ছিল। আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তার টেবিলে বসে রাতে কী স্বপ্ন দেখতাম তাই ওকে শেয়ার করতাম। তার কাছে একটা চিরকুট আগে থেকেই লেখা থাকত আমি স্বপ্নে দেখা কী কী সব বলব। আমার বলার পর সে চিরকুট এগিয়ে দিত এবং দেখতাম একেবারে মিলে যেত। কোনোদিন চিরকুট ফাঁকা থাকত। মজার ব্যাপার সে রাতে দেখা গেল আমি কোনো স্বপ্নই দেখতাম না।”

ক্লারা জেটকিন ১৯৩৩ সালে মারা যান।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল

দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প খ্যাত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ছিলেন অন্ধকারে আলোকবর্তিকা, আধুনিক নার্সিং সেবার অগ্রদূত, রয়্যাল রেডক্রসড এক অনন্যা প্রিয়দর্শিনী। ব্রিটিশ লাইব্রেরি সাউন্ড আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে ফ্লোরেন্সের কণ্ঠস্বর, যেখানে তিনি বলেছেন—“যখন আমি থাকব না, সেই সময় আমার এই কণ্ঠস্বর আমার মহান কীর্তিগুলোকে মানুষের কাছে মনে করিয়ে দেবে এবং এসব কাজের জন্য উৎসাহ যোগাবে।” তার জীবনী নিয়ে ১৯১২, ১৯১৫, ১৯৩৬ ও ১৯৫১ সালে চারটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

তিনি জানান, নার্সিং একটি পেশা নয়, এটি মূলত সেবা। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল ১৮২০ সালের ১২ মে অভিজাত ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্রিটিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করায় তার বাবা কন্যার নাম রাখেন ফ্লেরেন্স। আর সঙ্গে বাবার নাইটিঙ্গেল নামটি জুড়ে তার নাম হয় ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল।

ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন নারীরা শিক্ষা কী তাই বুঝত না। তবু বাবার আগ্রহে তিনি সে সময় একজন মানবতাবাদী লেখক এবং পরিসংখ্যানবিদ হয়েছিলেন। কেউ অসুস্থ হলে ফ্লোরেন্স সেখানে সেবা করতে ছুটে যেতেন। ডার্বিশায়ার থেকে যখন তিনি লন্ডনে আসেন তার বয়স তখন ১৭। সে সময় লন্ডনের হাসপাতালগুলোর অবস্থা ছিল খুবই করুণ। এর অন্যতম কারণ সে সময়ে কেউ সেবিকার কাজে এগিয়ে আসতেন না। এ পেশাকে তখন খুব ছোট করে দেখা হতো। সামাজিকভাবে এ পেশা তখনও পূর্ণ মর্যাদা পায়নি। অথচ ধনী, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ফ্লোরেন্স তখন নিজেকে একজন সেবিকা রূপে তৈরি করেন।

উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ফ্লোরেন্স একজন সেবিকা রূপে নিজেকে তৈরি করেন


মাত্র ১৭ বছর বয়সেই নাইটিঙ্গেল বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা তাকে সেবিকা হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছেন। প্রথমে এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করলে মা-বাবা রাজি হননি এই ভেবে, একজন শিক্ষিত মেয়ে হিসেবে তার যে কোনো ভালো পেশায় যাওয়া উচিত। আশা ছাড়েননি ফ্লোরেন্স। অবশেষে বাবা-মায়ের অনুমতি মিললে তিনি ১৮৫১ সালে নার্সের প্রশিক্ষণ নিতে জার্মানিতে উড়াল দেন।

১৮৫৫ সালে তিনি নার্স প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। ১৮৫৯ সালে নাইটিঙ্গেল ফান্ডের জন্য সংগ্রহ করেন প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ড। ১৮৫৯ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিসটিক্যাল সোসাইটির প্রথম সারির সদস্য নির্বাচিত হন। লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালে নার্সিংকে সম্পূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৮৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ যার বর্তমান নাম ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অব নার্সিং’। ডা. এলিজাবেথ ব্ল্যাকওয়েলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে চালু করেন ‘উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ’।

১৮৫৩ সালে শুরু হয় ক্রিমীয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বহু সৈনিক আহত হয়। সে সময় যুদ্ধাহতদের সেবায় ফ্লোরেন্স আত্মনিবেদন করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

আহত সৈন্যদের সেবার মাধ্যমে নার্সিংকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। হ্যারিকেন নিয়ে রাতের আঁধারে তিনি ছুটে গেছেন আহতদের দ্বারে দ্বারে। এরপর থেকেই বিশ্ব তাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ডাকতে শুরু করে। যুদ্ধের পর ফ্লোরেন্স বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

বিশ্ব তাকে ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ ডাকে


১৮৮৩ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘রয়েল রেডক্রস’ পদকে ভূষিত করেন। প্রথম নারী হিসেবে ‘অর্ডার অব মেরিট’ খেতাব লাভ করেন ১৯০৭ সালে। ১৯০৮ সালে লাভ করেন লন্ডন নগরীর ‘অনারারি ফ্রিডম’ উপাধি।

বহু মনীষী ফ্লোরেন্সকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন যারা এ পেশায় নতুন আসেন তারা ‘নাইটিঙ্গেল প্লেজ’ নামে একটি শপথ গ্রহণ করে তার প্রতি সম্মান জানান। তার সম্মানেই ১৯৭৪ সাল থেকে তার জন্মদিন ১২ মে পালিত হয়ে আসছে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে’।

ফ্লোরেন্স ১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট ৯০ বছর বয়সে মারা যান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর