শীত থেকে বাঁচতে হাজার হাজার পাখি নিজ দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে চলে আসে। অতিক্রম করে হাজার হাজার মাইল। প্রতিবছর শীতকালে আমাদের দেশেও এরকম কিছু অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন, হাজার হাজার মাইল দূর থেকে পাখিগুলো কিভাবে আমাদের দেশে আসে? আবার শীতশেষে কিভাবে দলবেঁধে ফিরে যায়? কোত্থেকে কোথায় যেতে হবে—দিকটা তারা নির্ণয় করে কিভাবে!
আমরা জানি প্রতিটি পাখির যাতায়াতের নির্দিষ্ট পথ রয়েছে, রয়েছে নির্দিষ্ট সময় এবং তারিখ। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের একটি দল পাখিদের এই দিকনির্ণয় এবং চলাচলের পথ নিয়ে বিস্তর গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণা শেষে তাদেরই একজন বলেন, পাখিদের ব্যাপারে গবেষণা করে যা জেনেছেন তাতে তারা কেবল অবাকই হয়েছেন।
পৃথিবীর প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখির মধ্যথেকে যেসব প্রজাতির পাখি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য কোনো দেশে চলে যায়, শুধুমাত্র সেসব পাখিদের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে। গবেষণায় জানা গিয়েছে—শুধু ইউরোপ আর এশিয়ায় এমন পাখি আছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির। কিছু কিছু পাখি প্রতিবছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াশে পাড়ি দিয়ে চলে যায় দূরদেশে। আমাদের অতিথি পাখিরা অতটা পথ পাড়ি না দিলেও তারাও অনেক দূর থেকেই আসে। বরফশুভ্র হিমালয় এবং হিমালয়ের ওপাশ থেকেই বেশিরভাগ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে কিভাবে দিকনির্ণয় করে পৌঁছে যায় পাখিরা?
আমাদের পৃথিবীর একটি নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র (magnetic field) আছে যেটা অনেক ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের মতে, এসব পাখিদের মস্তিষ্কের একটা অংশেও ম্যাগনেটাইট (magnetite) থাকে, যা একটা ছোট্ট কম্পাসের কাজ করে তাদের দিকনির্ণয় করতে সাহায্য করে। আগে গবেষকরা ভাবতেন, পাখির ঠোঁটে আয়রনসমৃদ্ধ কোষ থাকে যা ক্ষুদ্র কম্পাস হিসেবে কাজ করে। তবে নতুন গবেষণা বলছে, পাখির চোখে বিশেষ ধরনের প্রোটিন থাকে। যার ফলে চৌম্বকক্ষেত্র দেখতে পায় তারা।
তবে বিজ্ঞানীদের আরেকটি দলের অভিমত, পাখিদের চোখেই কিছু একটা থাকার কারণে তারা ওই চৌম্বকক্ষেত্রের সাহায্যে উত্তর-দক্ষিণ দিক চিনতে পারে। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র আমরা দেখতে পাই না, তাই এইরকম এঁকে সেটা বোঝানো হয়, দক্ষিণ দিক থেকে বেরিয়ে গিয়ে লাইনগুলো উত্তর দিকে ঢুকছে। উল্লেখ্য, উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুতে যে অরোরা নামে সুন্দর প্রাকৃতিক আলোর খেলা দেখা যায় তার পেছনেও এই চৌম্বকক্ষেত্রের ভূমিকা রয়েছে।
৩৯ ধরনের জেব্রা ফিঞ্চ এবং ইউরোপীয় রবিনের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। তাদের চোখের রেটিনায় আলো-সংবেদনশীল বিশেষ প্রোটিন ক্রাই ফোর (Cry4) বা ক্রিপ্টোক্রোমস পাওয়া গেছে। গবেষকরা দেখেন, দিনের বিভিন্ন সময়ে Cry1 এবং Cry2-এর মাত্রা ওঠানামা করে। তবে অপরিবর্তিত থাকে Cry4-এর মাত্রা। তার মানে হচ্ছে Cry4 একই হারে উৎপাদিত হতে থাকে। অবশ্য চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম এমন বিশেষ ধরনের অণুর কোনো জীব-জন্তুর দেহে উপস্থিতি এটাই প্রথম। জৈবিক ঘুমচক্র বা বায়োলজিক্যাল স্লিপ সাইকেলও নিয়ন্ত্রণ করে এই Cry4 প্রোটিন। একইসাথে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রতিও প্রতিক্রিয়াশীল।
মানুষের চোখে ফটোরিসেপটিভ কোণগুলো তিন ধরনের হয়। প্রতিটি কোণ লাল, সবুজ ও নীল রঙের আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয় যাকে ট্রাইক্রোমাটিক কালার ভিশন বলে। তবে পাখির চোখে আরো একটি বেশি কোণ থাকে। যাকে টেট্রাক্রোমাটিক কালার ভিশন বলে। এই অতিরিক্ত একটি কোণের কারণে পাখিরা আলোকরশ্মি ছাড়াও আল্ট্রাভায়োলেট ফ্রিকোয়েন্সিও দেখতে পায়।
আরো পড়ুন ➥ প্রাকৃতিক দুর্যোগের নামকরণ কিভাবে হয়
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় মূলত কোয়ান্টাম মেকানিজম কাজে লাগিয়ে। প্রোটিনের কোয়ান্টাম ইন্টার্যাকশন বা প্রতিক্রিয়া পাখিদের চৌম্বকক্ষেত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানান দেয়।
আরো পড়ুন ➥ শ্রবণে-পঠনে পার্থক্য করে না মস্তিষ্ক
আগের তত্ত্ব বলে, পাখিরা আকাশে ওড়ার সময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করে চৌম্বকক্ষেত্র দেখে। যখন আলোর কণা পাখির চোখে প্রবেশ করে তখন এটি ক্রিপ্টোকোমসে পড়ে। ফলে এটি তাড়িত হয় আর কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গল তৈরি করে। এটি এমন একটি অবস্থা যখন ইলেক্ট্রনগুলো আংশিকভাবে আলাদা হয়। তবে এ অবস্থাতেও একে অন্যের সাথে যোগাযোগ ও প্রতিক্রিয়া করতে পারে এসব ক্রিপ্টোক্রোমস।
তবে কিছু কিছু পাখি আছে যারা এই পদ্ধতির বাইরেও আরো কিছু পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে দিকনির্ণয় করে। কিছু পাখি সূর্য তারার অবস্থান থেকে পথ চিনে নেয়। তারা সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির (ultraviolet ray) উপস্থিতি টের পায়। সূর্যাস্তের সময়ে সূর্যের অবস্থান থেকে দিকনির্ণয় করতে পারে। বুঝতে পারে এখন সকাল দুপুর না সন্ধ্যা। নিশাচর পাখিরা আবার চাঁদের আলোকে ব্যবহার করে সময় এবং দিকনির্ণয় করে। এরা বিভিন্ন তারার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে তাদের দিক নির্ণয় করে। আবার কোনো কোনো পাখি দিক বুঝতে পারে তাদের চারপাশের পরিবেশ দেখে, যেমন নদী, পাহাড়, রাস্তা ইত্যাদি। কিছু কিছু পাখি তাদের ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করেও নিজেদের নীড়ে ফিরে আসতে পারে।
নিজস্ব যোগাযোগ ও দিকনির্ণয়ে পাখি যে অত্যন্ত উন্নত প্রাণি, এতে কোনো সন্দেহ নেই।