আরব্য রজনী বদলে দিয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের গতিমুখ

, ফিচার

আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 23:08:55

এই তো ক’দিন আগের কথা। তাও আবার এই বাংলাদেশে। পাড়া বা মহল্লার মানুষ দলবেঁধে বিটিভি খুলে অপেক্ষা করত সন্ধ্যায়। উপলক্ষ ‘আলিফ লায়লা’। আলাদিনের জাদুর চেরাগ, আলি বাবা ও চল্লিশ চোর কিংবা সিন্দাবাদের দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রার গল্প মানুষের মুখে মুখে ফিরছে তারও কয়েক প্রজন্ম আগে থেকে। এবং আরো আশ্চর্যের কথা হলো; পূর্বে চীন থেকে পশ্চিমে ইংল্যান্ড পর্যন্ত প্রায় সমানভাবে পরিচিত এই আখ্যানগুলো। বলা হয়ে থাকে সাহিত্যিক স্টাইলগুলোর আধার এটি। রোমান্টিক, এডভেঞ্চার থেকে শুরু করে রহস্য এবং উপকথা পর্যন্ত।

গ্রন্থের মূল নাম ‘আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা’ বা সহস্র এক আরব্য রজনী। ইংরেজিতে এরাবিয়ান নাইটস নামেই সমধিক বিখ্যাত। সৃষ্টির ব্যাপারে বাগদাদে নবম শতকের আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদকে উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পেছনে ছিল কয়েক শতাব্দীব্যাপী পণ্ডিতদের মিলিত প্রচেষ্টা। এইজন্যই ত্রয়োদশ শতকের সালাউদ্দিন আইয়ুবি এবং ক্রুসেডের প্রসঙ্গও উঠে আসে নানা উপলক্ষে। আরব, পারস্য, তুর্কি, গ্রিক এবং ভারতীয় উৎস থেকে আহরিত উপাদানে রচিত আখ্যানটি মাতিয়ে রেখেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তের শ্রোতাদের। ভীতি, রূপক, গভীর রাতের রহস্যানুসন্ধান, প্রেমোপাখ্যান, খোলামেলা রস-তামাশা আর শিক্ষণীয় বিষয়কে জড়াজড়ি করে গেঁথে রাখা হয়েছে জালের মতো। পশ্চিমে হরর গল্পের পথিকৃৎ এডগার এলান পো কিংবা এইচ পি লাভক্র্যাফট্ আরব্য উপন্যাস থেকে প্রভাবিত ছিলেন; তাদের লেখাতেই এসবের প্রমাণ আছে। আজকের আয়োজন আরব্য উপন্যাসের পাঁচটি প্রসঙ্গ নিয়ে।

এক যে ছিল খুনি রাজা

আরব্য রজনীর অজস্র গল্পকে মূলত বাক্সের মতো করে ধরে আছে মাত্র একটি গল্প। অন্যান্য হরর গল্পের তুলনায় বিষয়টা পাঠকের কাছে পরিণত হয়েছে আরো বেশি ভীতিকর হিসাবে। বাদশা শাহরিয়ার হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তার স্ত্রী তার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছে। তার অনুপস্থিতির সুযোগে শরীর বিকিয়ে দিয়েছে অন্য কারো কাছে। আরো কয়েকটা অনুরূপ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে যাবার পর নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্ম নেয় বাদশার। ফলে প্রতিদিন একটি নতুন বিয়ে করে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সে। সেই সাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাত্রিশেষে নববধুকে হত্যা করার।

শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা শেহেরজাদ এবং শাহরিয়ার


এভাবে চলতে থাকা হত্যাযজ্ঞের এক পর্যায়ে আগমন ঘটে উজির কন্য শেহেরজাদের। তার চিন্তা উন্মাদ বাদশার হাত থেকে রাজ্য বাঁচানোর। রাজা তাকে বিয়ে করলে প্রতি রাতে শেহেরজাদ গল্প বলতে শুরু করে। আর সকাল হবার আগে এমন জায়গায় গল্পের সমাপ্তি টানা হয়, যেখানে রাজার আগ্রহ অত্যুচ্চে। সুতরাং রাজা বাধ্য হন পরবর্তী রাতের জন্য শেহেরজাদকে বাঁচিয়ে রাখতে। এভাবে এক হাজার এক রাত পরে বাদশা শাহরিয়ার তার হত্যা করার পরিকল্পনা বাদ দেন। বর্তমান সময়ের বিখ্যাত সব হরর গল্পকে ভিত্তি ধরে পুরো ফ্রেমটাকে একটা আধুনিক হরর গল্প আর শাহরিয়ারকে তার ভিলেন দাবি করলে মোটেও ভুল হবে না।

ভূতের বাড়ি

আধুনিক ভৌতিক কিংবা থ্রিলার গল্পগুলোতে ফাঁকা ভৌতিক বাড়ি এবং তাতে রাত্রিযাপনের প্রসঙ্গ প্রায়ই আনা হয়। আরব্য উপন্যাসেও এর নজির মেলে। আলি এবং বাগদাদের ভূতুরে বাড়ি নামে একটা গল্পে একজন ব্যবসায়ীর বাগদাদ ভ্রমণের কথা এসেছে। আলি একটি বিশেষ বাড়ি সম্পর্কে নানা রকমে গুঞ্জন শোনে প্রতিবেশিদের মাঝে। বাড়ি নয় যেন জ্বীনের আখড়া। যে কেউ সেই বাড়িতে যায়; সকাল হবার আগেই বরণ করে মৃত্যু।

গল্পের কাঠামো ভৌতিক হলেও সমাপ্তিটা রসময়


স্থানীয় মানুষের ভীতিকর বর্ণনায় পাঠক তটস্থ হয়ে উঠলেও আদতে শেষ হয় রোমান্টিক রসময়তা নিয়ে। আলি সারারাত সেখানে ব্যয় করলেও জ্বীনেরা তাকে ভয় দেখায় না; বরং অগাধ পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে সহযোগিতা করে।

জ্বীন এবং তাদের জগৎ

অতিপ্রাকৃতিক সৃষ্টি হিসাবে গল্পগুলোতে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছে জ্বীন। প্রাক-ইসলামি আরবে জ্বীন বলতে বোঝাত এমন সত্তা; যা মরুভূমিতে তাড়া করে বেড়ায়। ইসলামের ব্যাখ্যা অনুসারে, জ্বীনেরা আগুনের তৈরি। বেশিরভাগ গল্পগুলোতেই জ্বীনেরা খারাপ বা ক্ষতিকর হিসাবে উপস্থাপিত হয়নি; বরং মানুষের সাহায্যকারী এবং সৎ ব্যক্তিদের উপকারের জন্য হাজির হয়েছে। তারপরেও রেগে যাওয়া জ্বীনদের ভীতিকর প্রতিশোধপরায়ণতাকেও চিত্রিত করা বাদ থাকেনি।

প্রায়শ গল্পের গতিমুখ বিস্ময়করভাবে বদলে দিয়েছে হঠাৎ জ্বীনের আগমন


উদাহরণস্বরূপ ‘ব্যবসায়ী এবং জ্বীন’ গল্পের প্রসঙ্গ টানা যায়। এক ব্যবসায়ী নিজের অসতর্কতা বশে এক জ্বীনের অদৃশ্য পুত্রকে হত্যা করে ফেললে রেগে যায় পিতা জ্বীন। সওদাগরকে হত্যা করতে তৎপর হয়ে উঠে সে। যদিও দিনশেষে সওদাগর ক্রুদ্ধ জ্বীনকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে মৃত্যু থেকে রক্ষা পায়। সেই ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করে তিনজন বৃদ্ধ নিজ নিজ অবিশ্বাস্য জীবনের গল্প বলার মাধ্যমে। জ্বীন তা শুনে সন্তুষ্ট হয় এবং খুন করতে চাওয়া ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়।

একটি ফাঁকা শহর

আরব্য উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ বারাস শহরের আখ্যান। গল্পে এক অভিযাত্রীর দল দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় হাজির হয় দেয়াল ঘেরা শহরে। বাইরের দেয়ালে মুখোমুখি হয় নয়নাভিরাম মুগ্ধকর রমণীদের; যাদের চতুরতায় অভিযাত্রীরা এক এক করে মৃত্যুমুখে পতিত হতে থাকে। এভাবে বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় জট। পরবর্তী যাত্রায় ভেতরের দিকে গেলে দেখা মেলে বিস্ময়কর সমৃদ্ধিতে ভরা প্রাসাদ। যাত্রার প্রতি স্তরে ছিল স্বর্ণ আর মণিমুক্তা। কিন্তু গোটা শহরটা ছিল নিশ্চুপ।

আরব্য রজনীকে গণ্য করা হয় বিচিত্র সব স্টাইলে গল্পের সমাবেশ হিসাবে


নাগরিক বলতে কেবল মৃতদেহ। দোকানে, বাড়িতে, বন্দরে সব জায়গায় মৃতদেহ। অভিযাত্রী দল এবার শহরের রাণীর কাছে গেলেন ঘটনার সুরাহা করতে। প্রথমে রাণীর ঝলমলে চোখ দেখে বিভ্রান্ত হলেও অচিরেই বুঝতে পারে রাণী নিজেই মৃত্যুর কাছে হার মেনে নিয়েছেন। পাশের শিলালিপি থেকে পরবর্তীতে ঘটনা পরিষ্কার হয়। নগরীটি এক দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। নানা প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে নাগরিকেরা যে যার জায়গায় গিয়ে নিজেদের ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করছিল। পরিণামে জুটেছে মৃত্যু। পুরো গল্পে সম্পত্তির ক্ষণিকতা স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিয়েছে।

পিশাচ এবং ভূত

ইংরেজিতে ghoul শব্দটি মূলত এসেছে আরবি থেকে। আরব্য উপন্যাসে রাতের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর আর বিকট বিশেষ প্রাণী হিসাবে পিশাচের উল্লেখ আছে। জ্বীনদের থেকে তাদের তফাৎ আছে। তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—মানুষের রক্ত আর মাংসের জন্য প্রায়ই তাদের আগমন ঘটে। আরবি উপকথায় আছে, তাদেরকে হত্যা করা যায়। কেবলমাত্র একবার ঘা দিলেই তাদের মৃত্যু ঘটবে। তবে আবেগের বশে দ্বিতীয় ঘা দিয়ে বসলেই বিপদ। পুনরায় জীবনে ফিরে আসবে সেই পিশাচ।

এডগার এলান পো কিংবা স্টিফেন কিং অনুপ্রেরণা পেয়েছেন আরব্য রজনীর থেকে


এই ধরনের গল্পগুলো পরবর্তীতে ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার কিংবা অন্যান্য ভৌতিক প্রাণীর আগমণ ঘটাতে সহযোগিতা করেছে সাহিত্যিকদের। এর বাইরে আলি বাবা কিংবা আলাদিনের মতো জনপ্রিয় গল্পগুলো তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের বিস্ময়কর গল্পসংকলনের নাম আরব্য রজনী; যা বদলে দিয়েছে অন্যান্য অনেক ভাষায় সাহিত্যের গতিমুখ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর