যে তিন বিদেশিনী মহাত্মা গান্ধীর কাছে ছুটে এসেছিলেন

, ফিচার

জাভেদ পীরজাদা, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-25 02:35:52

আজ ২ অক্টোবর ভারতের জাতির পিতা ‘বাপু’খ্যাত মহাত্মা গান্ধীর দেড়শততম জন্মবার্ষিকী। তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। অহিংসনীতি সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খ্যাত হয়। কারাগারে ছিলেন ১৭ বার। অনেক নারীই তার কাছে পেয়েছেন অনুপ্রেরণা। আশ্রয় নিয়েছেন। এমন তিন বিদেশি নারীর মধ্যে ছিলেন মেডেলিন স্লেড, ওরফে মীরা। মেডেলিন স্লেড ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল স্যার এডমন্ড স্লেডের মেয়ে। এক ব্রিটিশ অফিসারের মেয়ে হওয়ার কারণে তাঁর প্রথম জীবনটা ছিল কঠোর অনুশাসনে বাঁধা। জার্মান সংগীতকার ও প্রবাদপ্রতিম পিয়ানো শিল্পী বেঠোফেনের সাংঘাতিক রকমের ভক্ত ছিলেন স্লেড। সেই সূত্রেই তিনি ফরাসি লেখক রোম্যাঁ রোল্যাঁর সংস্পর্শে আসেন। রোম্যাঁ রোল্যাঁ আবার ছিলেন ভারতীয় কালচারের গবেষক। রোম্যাঁ গান্ধীকে নিয়েও লিখেছেন। সেই বই পড়ে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে জানতে পারেন মেডেলিন স্লেড। এরপর গান্ধীর ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লিখেন, “আমি আপনার পথের সঙ্গী হতে চাই। পথের সাথী করবেন কি?” এর আগে মদ, চুরুট সবই খেতেন মেডেলিন স্লেড। গান্ধী ভেজিটারিয়ান জেনে তিনিও ভেজিটারিয়ান হয়ে যান। নিয়মিত পড়তে শুরু করেন মি. গান্ধীর সম্পাদিত কাগজ 'ইয়ং ইন্ডিয়া’। সেই তিনি ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের মুম্বাই হয়ে আহমেদাবাদে আসেন।

গান্ধীর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনা মেডেলিন এইভাবে বর্ণনা করেন, “আমি দেখছিলাম সামনে একজন রোগাপাতলা মানুষ সাদা চাদর থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি জানতাম উনিই বাপু। মনটা শ্রদ্ধায় ভরে গিয়েছিল। সামনে একটা আশ্চর্য দিব্য জ্যোতি দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বসে পড়েছিলাম। ‘তুমি তো আমার কন্যা!’—আমাকে টেনে তুলে বলেছিলেন বাপু।” সেই দিন থেকেই দুজনের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে, মেডেলিনের নামই হয়েছিল মীরা। স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিলেন ভারতে।

নীলা ক্র্যাম কুক


আরেকজন হচ্ছেন, নীলা ক্র্যাম কুক। মার্কিন নাগরিক। নীলা ক্র্যাম কুক মহিসুরের রাজকুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। সেখানে থাকার আগে রাজস্থানের এক ধর্মীয় গুরুর কাছেও থাকতেন তিনি।

১৯৩২ সালে প্রথমবার নীলা চিঠি লেখেন মি. গান্ধীকে। ব্যাঙ্গালোর থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে তিনি অস্পৃশ্যতা-বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সেখানে ঠিক কী হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে শুধু চিঠিতেই দুজনের যোগাযোগ ছিল। পরের বছর নীলা ক্র্যাম কুক প্রথমবার মি. গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন পুনের ইয়ারওয়াডা জেলে। সেসময় তিনি গান্ধীর আশ্রয়ে থাকতে চান। গান্ধী তাঁকে সবরমতী আশ্রমে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আশ্রমের অন্যান্য নতুন সদস্যদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল কুকের। তবে অনেকে কুককে ‘নীলা-নাগিন’ বলেও ডাকতে শুরু করেছিলেন তাঁর আড়ালে। দেখতে ভীষণ যৌনআবেদনময়ী ছিলেন। উদার চিন্তাভাবনার কুকের পক্ষে গান্ধী-আশ্রমের পরিবেশে বেশিদিন মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। একদিন হঠাৎই তিনি আশ্রম থেকে পালিয়ে যান। পরে তাঁকে বৃন্দাবনে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। নিজেকে তখন তিনি কৃষ্ণের সঙ্গিনী গোপী বলে ভাবতে শুরু করেছেন। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে আমেরিকায় ফেরত যেতে হয়েছিল।

মহাত্মা গান্ধী ও মার্গারিটা স্যাঙ্গার


তৃতীয়জন ছিলেন মার্গারিটা স্যাঙ্গার। তিনি জন্মনিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাকারী একজন মার্কিনী স্বাস্থ্যবিদ। মার্গারিট স্যাঙ্গারের সাথে ১৯৩৫ সালে গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল এরই ভিত্তিতে মূলত ‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের বইটি লেখেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। গান্ধীর কাছে মার্গারেট স্যাঙ্গার জানতে চেয়েছিলেন, “সেক্সকে কিভাবে দেখেন আপনি?” গান্ধী জবাবে বলেছিলেন, “কামনা আগুন। যা মানুষকে ধ্বংস করে দিতে পারে। নষ্ট করতে পারে।” মার্গারিটের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, “আপনি তবে বিয়ে করেছিলেন কেন?” গান্ধীর জবাব, “আমার বাবার ইচ্ছায় বিয়ে করেছি অতি অল্প বয়সে। সন্তান জন্ম দিয়েছি। কিন্তু সেক্স করার পর অপরাধবোধে ভুগতাম। যদিও বলি মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য যতটুকু সেক্স করা দরকার সংসার জীবনে ততটুকুই সেক্স করা দরকার এক সংসারী মানুষের। এর বেশি না।” গান্ধী চাইতেন শুধু আনন্দের জন্য যৌনমিলন করাকে নারীরা যেন প্রতিরোধ করে। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট নিয়েছিলেন গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই। গান্ধীর সাথে এসব আলাপচারিতার পর মার্গারিট স্যাঙ্গারও যৌনজীবন পরিত্যাগ করেন এবং ভারতে এসে গান্ধী আশ্রমে বসবাস শুরু করেছিলেন। যদিও তিনি পরে মার্কিন মুল্লুকে ফিরে যান গান্ধীর মৃত্যুর পর।

আরো পড়ুন ➥ সরোজিনীর মহাত্মা গান্ধীকে ‘মিকি মাউস’ ডাকার ইতিহাস

এ সম্পর্কিত আরও খবর