সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের উত্থান এবং পতন

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 10:56:04

সময়টা এখন অ্যান্ড্রয়েডের। সবার হাতে হাতে এখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন। কিন্তু খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, এই তো ২০১০ সালের আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। অ্যান্ড্রয়েড সারাবিশ্বের স্মার্টফোনগুলোকে শাসন করার আগে, স্মার্ট ডিভাইসগুলোর জন্য সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য অপারেটিং সিস্টেম ছিল সিম্বিয়ান। আজকে যেমন অ্যান্ড্রয়েড ছাড়া ফোনের কথা চিন্তা করা যায় না, তেমনিভাবে সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম ছাড়াও একটি ভালো ফোনের কথা চিন্তা করা যেত না। স্মার্টফোন মানেই তখন ছিল সিম্বিয়ান।

২০১০ সালের দিকে এন্ড্রয়েড যখন প্রথম আসে। বাজারে তখনও সিম্বিয়ান ফোনের জয়জয়কার। সিম্বিয়ান বাজারে এসেছে অবশ্য অনেক আগে। ১৯৮০-র দশকে পিশন (Psion) নামে একটি সংস্থা সিম্বিয়ানকে একটি অপারেটিং সিস্টেম হিসাবে বাজারে নিয়ে আসে। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিলো EPOC। ১৯৯৮ সালে, টেলিফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নোকিয়া, এরিকসন এবং মটোরোলার সাথে একটি যৌথ উদ্যোগে পিশন রূপ নেয় সিম্বিয়ানে। আর EPOC তখন থেকেই নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম। সিস্টেমটি ARM প্রসেসরগুলোতে চালানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল এবং তখনকার সময়ে সবচেয়ে শক্তিশালী স্মার্টফোনগুলোর কয়েকটিতে ব্যবহার করা হয়েছিল।

২০০০ সালের দিকে স্যামসাং এবং এলজিও সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের আওতায় নিজেদের যুক্ত করেছিল। এরিকসন কোম্পানির ‘আর-৩৮০’ ছিল বিশ্বের প্রথম সিম্বিয়ান মোবাইল ডিভাইস। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। পতনের আগে পর্যন্ত বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেই তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল।

এরিকসন আর-৩৭০ ছিল প্রথম কোনো সিম্বিয়ান ফোন


সিম্বিয়ানের সাথে যুক্ত হওয়ার পর প্রতিটা প্রতিষ্ঠান আশাতীত সাফল্য পেতে শুরু করে। নোকিয়া, সামস্যাংসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান লাভবান হতে থাকে। বাজারে আসতে থাকে নতুন নতুন বাহারি রকমের সব মোবাইল ফোন। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অগ্রযাত্রার কারণেই হয়তো ২০০৭ সালে যখন আইফোন বাজারে আসে তখন সিম্বিয়ান কর্তৃপক্ষ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। গুরুত্ব দেয়নি ২০০৮ সালে বাজারে অ্যান্ড্রয়েডের আগমনকেও।

বাজারে তখন সিম্বিয়ানকে শক্ত প্রতিযোগিতায় ফেলার মতো কোনো সম্ভাবনাই ছিল না কারো। এরইমধ্যে ২০০৮ সালে নোকিয়া নিজেদের অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে সিম্বিয়ানকে পুরোপুরিভাবে কিনে নেয়। এরপর থেকে নোকিয়ার মাধ্যমে অপারেটিং সিস্টেমটি সফলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

ইতোমধ্যে বাজারে এসে যাওয়া অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম চুপচাপ বসে ছিল না। বিভিন্ন ফোন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে তারা নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা সরবরাহ করতে শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের দিকে এলজি, স্যামসাং-এর মতো কোম্পানিগুলো অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করল। অ্যান্ড্রয়েড এবং পাশাপাশি আইওএস এরই মাঝে বেশকিছু আকর্ষণীয় মোবাইল ফোন বের করে বাজারে সাড়া ফেলে দিল। আর তখনই প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিমূলক পরিবেশ টের পেল সিম্বিয়ান।

সেই সময়েও নোকিয়া আঁকড়ে ধরে থাকল সিম্বিয়ানকে। তারা সিম্বিয়ান ফাউন্ডেশন পরিচালনার দায়িত্ব নিল এবং নোকিয়া ৫৮০০সহ আরো দুয়েকটি মডেলের স্মার্টফোন নিয়ে এলো বাজারে। সাড়াও ফেলল খুব। এরপর নিয়ে এলো তৃতীয় সংস্করণ। যেটাতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুযোগ সুবিধা ছিল বেশি। উন্নত গ্রাফিক্স, উইজেট সমর্থন এবং মাল্টিপল স্ক্রিন ইত্যাদি। কিন্তু এটা করতে তারা একটু দেরি করে ফেলেছিল। কেননা প্রতিযোগী অপারেটিং সিস্টেমগুলো এর আগেই সেসব ফিচার যুক্ত করে দিয়েছিল তাদের ডিভাইসগুলোতে।

সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের সর্বশেষ সফল ডিভাইস নোকিয়া ৫৮০০


নোকিয়া তবুও হাল ছাড়ল না। তারা সিম্বিয়ান প্রযুক্তিটি উদ্ধার করার জন্য একটা শেষচেষ্টা করল। সিম্বিয়ান আন্না এবং বেল নামে দুটি আলাদা আপডেটেড ভারসন নিয়ে এলো যা খুব বেশি ইউজার ফ্রেন্ডলি। ব্রাউজিং স্পিড বৃদ্ধিতে সহায়তা করত। পাশাপাশি এর ইউজার ইন্টারফেজও ছিল খুবই আশাব্যঞ্জক। বেল সংস্করণে উইজেটগুলির কাস্টমাইজেশনসহ অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে। এছাড়াও, এটি আরো বেশি হোমস্ক্রিন এবং একটি স্ট্যাটাস স্ক্রিন যুক্ত করে যা অনেকটা অ্যান্ড্রয়েডেরই মতো। পাশাপাশি পুল ডাউন মেন্যুর মাধ্যমে যে কেউ সাথে সাথে সেটিংসে প্রবেশ করতে পারে এবং চাইলে কাউকে টেক্সটও পাঠাতে পারে।

সিম্বিয়ান বেল ছিল সিম্বিয়ানের বাঁচা মরার প্রশ্নে শেষ উদ্যোগ


মোটকথা অ্যান্ড্রয়েড যেসব সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে তার সবই যুক্ত করা হয়। কিন্তু ওই যে বলে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না!’ সত্যিই তাই। যার ফলে এত আধুনিক ফিচার নিয়ে এসেও খুব বেশিদিন তারা এটাকে আর ধরে রাখতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই বাজারে সিম্বিয়ানের শেয়ার পতন ঘটতে থাকে খুব দ্রুত হারে।

শুধু যে আধুনিক ফিচারগুলো দেরিতে নিয়ে আসায় তাদের পতন হলো ব্যাপারটা এমন না। সিম্বিয়ান তাদের মার্কেটিং প্ল্যানেও বেশ খানিকটা পিছিয়ে ছিল। সিম্বিয়ান প্ল্যাটফর্মের সাফল্য প্রথম উপলব্ধ হয়েছিল ২০০৪ সালের প্রথম চার মাসেই। যেখানে এটি ২.৪ মিলিয়ন ডিভাইস বিক্রি করেছিল। অথচ পুরো ২০০৩ সালেই তারা এতগুলো ফোন বিক্রি করতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের বিক্রি বৃদ্ধি পেলেও তারা আর এই সূচককে অতিক্রম করতে পারেনি। বরং তাদের কেবল অবনতিই হয়েছে। স্যামসাং, এলজি কিংবা এরিকসন সিম্বিয়ানের সাথে যুক্ত হতে চাইলেও তখন সিম্বিয়ান তাদের ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগী ছিল না। অনেকেই মনে করেন সেসময় নোকিয়ার একচেটিয়া বাজার থাকায় সিম্বিয়ান অন্যদের নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। এটাও সিম্বিয়ানের পতনের একটা বড় কারণ।

সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের অন্যতম সফল ডিভাইস নোকিয়া এন৭০


পতনের এই পালে শেষ পেরেক গেঁথে দেন নোকিয়ার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। ২০১১ সালে নিযুক্ত হওয়ার পরেই তিনি ঘোষণা করেন নোকিয়া এবং মাইক্রোসফট একসাথে কাজ করবে। নোকিয়ার বাজার সম্প্রসারণ এবং এর গ্রাহকদের জন্য উইন্ডোজ ফোন তৈরির ঘোষণা দেন তিনি। এরপরেই মূলত সিম্বিয়ান ধীরে ধীরে বাজার থেকে বিদায় হতে থাকে। দুমাস পরেই তারা সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমের কোড সোর্সিং বন্ধ করে দেয় এবং কর্মীদের ছাঁটাই করতে শুরু করে।

আর এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে সিম্বিয়ান প্ল্যাটফর্মের রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর উন্নয়নের বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর এপ্লিকেশন ডেভেলপাররা সিম্বিয়ানের জন্য আর কোনো অ্যাপ্লিকেশন তৈরি বা প্রকাশ করতে পারেনি। সময় মতো নিজেদের সিস্টেমের উন্নতি করা এবং প্রতিযোগী ও সহযোগীদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি সিম্বিয়ান। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজার থেকে বিদায় নেয় সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম।

এ সম্পর্কিত আরও খবর