‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম’

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 19:06:04

আজ পহেলা আষাঢ়। শুরু হলো জলমগ্ন মেঘ ও বৃষ্টির ঋতু বর্ষার । এমন মায়াবী দিনে মানুষ প্রিয়ার হাতে বরাভয়ের হাত রেখে বলতে চায়: ‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি – তোমাকে দিলাম।’ কিন্তু গান, কবিতা, সাহিত্যের মতো বর্ষা নিয়ে এতোটা রোমান্টিক কি আজকাল বাস্তবিকই হওয়া সম্ভব হয়?

আকাশ জুড়ে মেঘের মেলা আর বৃষ্টির নিক্কন এখন সামাজিক জীবনে বিড়ম্বনার সমার্থক হয়েই এসেছে। সাহিত্যের ‘বর্ষাদূত’ হাল আমলে ‘ভীতিরদূত’ও বটে। বর্ষা বর্তমানে এন্তার সমস্যার নামান্তর। যদিও আবহমান বাঙালি জীবনে ঋতুচক্রে বর্ষার গুরুত্ব অনেক। বর্ষায় বাংলার প্রকৃতি অবগাহন করবে সজীব বারিধারায়। কাব্য কথায় এসেছে, ‘আষাঢ়স্য’ প্রথম দিনেই নাকি কদম বনে হলদে-সাদা মঞ্জুরীর উচ্ছ্বাস বইতে শুরু করে। বাংলা প্রকৃতিতে দৃশ্যমান হতে থাকে স্নিগ্ধতার অন্যরকম আবেশ। হাল আমলে সে আবেশ পর্যবসিত হয়েছে বিড়ম্বনায়।

বর্ষা নিয়ে কবিতায় বলা হয়েছে, “মেঘে আঁধার হল দেখে/ ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই,/ শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে/ কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।/আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু/শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু।/ কালো? তা সে যতই কালো হোক,/ দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।” কবি যে বর্ষাকে মানবীর চিত্রকল্পে ‘কালো হরিণ-চোখ’-এর মায়াময়তায় অংকিত করেছেন, সে বর্ষা এখন চোখ রাঙাচ্ছে নিরাপদ জীবনকে। অতলে তলিয়ে নিয়ে জমা-পানিতে। আমরা সেই পানিকে যথাযথভাবে গ্রহণ ও ব্যবহারের পথ রাখি নি বলেই জীবন নামের পানি হয়েছে কষ্টের কারণ।

প্রচলিত একটি বাংলা জারি গানে আছে: “আইলোরে আষাঢ় মাস /লাগাইলো চারা গাছ/গাছে গাছে ঝগড়া করে/মূল্য বেশি কার?” বর্ষণসিক্ত পরিবেশ বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময় হিসেবেই বিবেচ্য স্মরণাতীতকাল থেকেই। সারাদেশে বৃক্ষমেলার আয়োজন হয়ে থাকে এ মাসেই। কিন্তু এ কাজটিও আমরা ঠিক ঠিক করছি না। পাহাড়ের গাছ এবং খোদ পাহাড়টিকেই কেটে ফেলছি। ভূমিধ্বস আর পাহাড়ধ্বসে মরছে তাই অসংখ্য মানুষ।

বঙ্গাব্দের অন্যান্য মাসের মতো বর্ষার দুইটি মাস আষাঢ় ও শ্রাবণের নামকরণও হয়েছে তারার নামে। সে তারার নামে মাসগুলো. অথৈ পানি তাদের বৈভব। যে নবধারা জলে- ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’সহ নিসর্গ চেতনা প্রতিটি প্রকৃতি প্রেমিক মনকেই আলোড়িত করার কথা থাকলেও পরিস্থিকিতে আমরা উপভোগের জায়গা থেকে নিয়ে গিয়েছি বিপদের জায়গায়। ‘কালো হরিণ-চোখ’ কিংবা কদম, শাপলা, পদ্ম, চালতা, কেতকী ফুল ফোটার বর্ষার দেখার উপায় নেই জলে আবদ্ধ বিপন্ন নাগরিকের।

অথচ একমাত্র ‘কবি শেখর’ কালিদাসই বর্ষা ঋতুকে নিয়ে কমপক্ষে ত্রিশটি কবিতা লিখেছেন। ‘ছন্দের জাদুকর’ খ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বর্ষাকেন্দ্রিক কবিতাগুলো হলো ‘বর্ষা’, ‘ইলশে গুঁড়ি’ ও ‘বর্ষা নিমন্ত্রণ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাপ্রীতি রীতিমতো প্রবাদতুল্য। এছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীমউদদীন, শক্তিমান কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা প্রমুখ কবি বর্ষাকে তাদের সাহিত্যকর্মে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে।

চিত্রশিল্পীরাও বর্ষাকে ক্যানভাসে আঁকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পটুয়া কামরুল হাসানের ‘বৃষ্টির দিনে খেয়া ঘাট’ শীর্ষক চিত্রকর্মটি আজো অনন্য হিসেবে স্বীকৃত। ফলের সমাহার এ মাসে এসেও লক্ষণীয়। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, লুকলুকি, জামরুল, লিচু, লটকন - আরও কতো দেশীয় ফল! বিপন্ন নগর জীবনের আক্রান্ত নাগরিকদের পক্ষে বর্ষার নান্দনিক রূপের মতো ফুল-ফলে আমোদিত হওয়াও সম্ভব হয় না। কারণ আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বন্ধুতুল্য-প্রকৃতিকেই শত্রুতে রূপান্তরিত করেছি।

কিভাবে সম্ভব হবে বর্ষার নানা উৎসব উপভোগ করা? যখন জীবনকেই বর্ষার ছন্দময় সময়ে আমরা আক্রান্ত ও বিপদগ্রন্ত দেখতে পাচ্ছি। অথচ বর্ষার আরেক পরিচয় উৎসবের জন্য সুবিদিত। বিশেষ করে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’, পালনকারীদের কাছে বড়ই আরাধ্য এ ঋতু। কে না জানে এ মাসে রথযাত্রা উৎসব হয়। হিন্দু শাস্ত্র মতে, পুরীর জগন্নাথের স্মরণে এই উৎসব টেনে নিয়ে যায় এবং স্নান করিয়ে ফিরিয়ে আনে। এই প্রত্যাবর্তনই ‘উল্টো-রথযাত্রা’নামে পরিচিত।

এ উপলক্ষে বসে মেলা। গ্রামবাংলায় তো মেলা মানে সার্বজনীন আনন্দ জোয়ার। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) সর্বশেষ ১৩৯০ বঙ্গাব্দে প্রণীত ‘বাংলাদেশের মেলা’ গ্রন্থে ৬৮টি বর্ষাকালীন মেলার কথা বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মাত্র ১৬টি ছাড়া বাকি ৫২টিই রথযাত্রা কেন্দ্রিক। রথযাত্রা কিংবা উল্টো-রথযাত্রা মেলা সর্বাধিক সংখ্যক বসে ময়মনসিংহ জেলায়, যার সংখ্যা ১৫টি। এছাড়া বসে জামালপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, পাবনা, যশোর, রাজশাহী, ফরিদপুর জেলায়। তবে ঢাকার ধামরাই ও মানিকগঞ্জের রথযাত্রা উৎসবের খ্যাতি দেশজোড়া।

অতএব অফুরন্ত আনন্দ ও উৎসবের বর্ষা উপকারী হলেও ক্রমে ক্রমে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের ভুল পদক্ষেপ ও প্রকৃতিবিরোধী অনাচারের কারণে বর্ষার অপকারী নানা দিকও আমাদেরকে অক্টোপাসের মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। সজল বর্ষা প্রকৃতিতে ফুরফুরে আমেজ আনলেও নদীগুলোতে পানি প্রবাহ বেড়ে, শহরে-নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। এর দায় বর্ষার না আমাদের? এই পরিস্থিরি জন্য দায়ি কে? প্রকৃতি? নাকি প্রকৃতি বিনাশী মানুষ?

বিদিত যে, বর্ষা পানির সাথে পলি বয়ে এনে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হিসাবে বাংলাদেশকে বিনির্মিত করেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। বর্ষা ঋতুই প্রাণপ্রবাহ জাগিয়েছে সবুজাভ বাংলাদেশের। তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ বর্ষাকে বলেছেন- ‘ধ্যানমগ্ন বাউল, সুখের বাঁশি’। বিদায়ী গ্রীষ্মের পুরোটা জুড়েই যখন ছিল দাবদাহের দাপট, তখন বর্ষাই আনে ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি।’ যখন ‘শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়ায়ে/ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।’ বর্ষায় মানুষের প্রাণ জুড়ায়। প্রকৃতি আবার জেগে উঠে।

কিন্তু জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে এবং আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশ-বিরুদ্ধ নানা (অপ)পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; ঋতুর ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক ও ক্ষতিকর দিকগুলোই বড় হয়ে উঠছে। বর্ষা হয়েছে ‘কারো জন্য পৌষ মাস, কারো জন্য সর্বনাশ’।

তথাপি বর্ষায়, বিশেষ করে ছুতোর সম্প্রদায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাতদিন কাজ করছে। কাঠের তক্তা ‘রান্দা’ দিচ্ছে, ‘পাতাম’ ঠুকে নৌকা বানাচ্ছে। গলুইওয়ালা নৌকা, কোষা, ডিঙ্গি নৌকা। পানিতে নয়, জলমগ্ন রাস্তাতেও চলছে সেই নৌকা। বর্ষার নতুন পানি পেয়ে সোনা ব্যাঙের দল সমস্বরে গেয়ে উঠছে ‘গ্যাঁকো-গ্যাঁকো’, মাছ শিকারে নামছে পেশাজীবী, সৌখিন মানুষ। উৎফুল্ল ময়ূরের মতোই চিন্তাশীল-ভাবুকেরা মনের পেখম তুলে অনির্বচনীয় অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।

অনেকেই আনুষ্ঠানিকতায় বর্ষাকে বরণ করেন। অনেকেই, বিশেষত, সর্ব-সাধারণ নগরজীবনে বর্ষার কুপ্রভাব, প্রকোপ ও পানিবন্দিত্ব কাটাতে লড়াই করেন। বর্ষামঙ্গল যেন বাস্তবতা ছেড়ে চলেছে স্মৃতি ও কল্পনার রাজ্যে। অঝোর বৃষ্টিতে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যেন আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছে চরম দুর্ভোগে।

বর্ষার কষ্টগুলোকে দমন করে নিসর্গময় অনিন্দ্য দিন আর রাত্রিকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচেষ্টায় নগর জীবনে এমন আনন্দময় বর্ষা আনতে হবে, যার সারাটা দিন ও বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোটাগুলো নিশ্চিন্তে প্রিয়তমের হাতে তুলে দিয়ে মন খুলে বলা যায়: ‘আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি – তোমাকে দিলাম।’

কিংবা বৃষ্টির চিত্রকল্পে খুঁজে পাওয়া যায় প্রিয়জনের নস্টালজিক ইমেজ: 'তোমার শহরে বৃষ্টি এখন, আমার শহরে রোদ/

তোমার দু'চোখে ঝরছে অঝোরে আমার জীবনবোধ'। আসলেই, বর্ষা হলো বাঙালির প্রেম ও প্রকৃতিচেতনার চিরায়ত ধ্বনিমাখা অবিরাম জীবনবোধ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর