নিজের ব্যক্তিত্ব কি পরিবর্তন করা যায়?

, ফিচার

তানিম কায়সার, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 14:10:22

একবার একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা হয়ে গেল এক ভদ্রলোকের সাথে। ওয়েটিং রুমে আমারই পাশের সোফায় বসেছিলেন তিনি। অল্প পরিচিত হওয়ায় সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার পরে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কী করি। উত্তরে বললাম পড়াশোনা। তিনি তখন আমাকে আমার পড়াশোনা রিলেটেড একটি প্রশ্ন করলেন। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়ায় উত্তর দিতে গিয়ে ‘ইয়ে মানে’, ‘মনে হয়’ এসব বলতে শুরু করলাম। লোকটি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি যা বলব তা কিন্তু, ইয়ে মানে, মনে হয়, হতে পারে এসব দিয়ে বলব না। আমি যা বলব কনফার্ম করেই বলব।”

আমি তার কথা শুনে অবাক হলাম। তাকে কিছুটা থামিয়ে দিয়ে আমাকে করা প্রশ্নের জবাব বলতে শুরু করলাম। যদিও উত্তরের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পেরে আমাকে বললেন, যা জানেন না, তাও বলার ইচ্ছে হচ্ছে, এটা তো ভালো ব্যক্তিত্বের লক্ষণ না।

আমি এবার আর কথা বাড়ালাম না, থামলাম। এই লোকটা আমার বোকামি ধরে ফেলেছেন। এরপর লোকটা চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বললেন, একটু নাড়া দিলাম, যাতে বদলে যান। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার চলে যাওয়া দেখতে থাকলাম। কিন্তু তার বলা কথাগুলো আসলেই আমাকে নাড়িয়ে দিল। আজকে তাই ‘ব্যক্তিত্ব’ নিয়ে আলোচনায় আমার এই গল্পটাই প্রথমে মনে পড়ে গেল।

মানুষ তার স্বাভাবিক যে সমস্ত বাহ্যিক ও মানসিক আচরণ বা বৈশিষ্ট্য দ্বারা অন্য ব্যক্তি বা সমাজকে প্রভাবিত করে তাকে ব্যক্তিত্ব বলে। একজন মানুষের নিজেকে তারই মতো অন্য আরো একশজন থেকে আলাদা করে নেওয়ার একমাত্র উপায় হলো তার ব্যক্তিত্ব। আমরা প্রায়শই বলি, “শুধু মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না।” এই যে একজন মানুষ আসলেই মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছেন কিনা তা নির্ধারণ করে দেয় তার ব্যক্তিত্ব।

বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তিত্ব একটি আপেক্ষিক বিষয়, সাধারণত একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষের মধ্যে যেসকল গুণ লক্ষ করা যায় তা হলো—সামাজিক, আত্মসচেতন, বুদ্ধিমান, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ, আবেগময়তা, আত্মবিশ্বাস, সাফল্য অর্জন ইত্যাদি।

বিজ্ঞানীগণ মনে করেন আমাদের ব্যক্তিত্বসমূহ অনেকটা দাঁতের মতো। এরা দিনের পর দিন স্থিতিশীল থাকে, তবে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনও হতে পারে। তাহলে আমরা কিভাবে তাদের পরিবর্তন করব? দাঁতের ক্ষেত্রে এটি পরিষ্কার, আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করা হয় চিকিৎসার মাধ্যমে। তবে আমাদের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটি অস্পষ্ট। সবার মনেই এই প্রশ্নটা আসে—ব্যক্তিত্ব কি কেবল জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চার, নাকি নিজের ব্যক্তিত্বকে উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিবর্তন করা যাবে?

সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে লোকজন তাদের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান করতে কমবেশি অনেক পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। থেমে নেই বিজ্ঞানীরাও। এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান করতে গিয়ে শুরুতে তারা ৩৭৭ জন মনোবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীকে বাছাই করেছিলেন এবং তাদের ৬০টি প্রশ্ন দিয়েছিলেন। যেগুলোর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্ব পরীক্ষা করা হয়। যেখানে ব্যক্তিত্ব গঠনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বিষয় বা ‘বিগ ফাইভ’কে পরিমাপ করা হয়েছে। ‘বিগ ফাইভ’ বা সেই পাঁচটি বিষয় হলো অকপটতা, নীতিবোধ, বহির্মুখিতা, সম্মতি এবং স্নায়ুবিকলতা।

এরপরে, তারা অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করলেন, তাদের মধ্যে সেই পাঁচটি বৈশিষ্টের এমন কোনো একটি বা একাধিক বৈশিষ্ট্য রযেছে কিনা যেটি তারা পরিবর্তন করতে চান। তাদের অনেকেই দুটি বৈশিষ্ট্য বেছে নিয়েছিল যার ওপর তারা কাজ করতে চান। তবে সবচেয়ে বেশি মানুষ যেটি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন সেটি হলো স্নায়ুবিকলতা হ্রাস (উদ্বেগের সময়ে উদ্বিগ্ন না হওয়া এবং উদ্বেগ কমানো)।

নিজেদের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে পরবর্তী ১৫ সপ্তাহের জন্য প্রতি সপ্তাহে অংশগ্রহণকারীরা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তৈরি করা চারটি ‘চ্যালেঞ্জ’ গ্রহণ করে। এগুলো তৈরি করা হয়েছিল কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুক্তিসঙ্গত এবং পরিমাপযোগ্য বিষয় হিসেবে যা চিন্তার ধরন এবং অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ—স্নায়ুবিকলতা প্রতিরোধের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, যেখানে তাদের বলা হয় আপনি যখন ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হন, কমপক্ষে দুই মিনিট ব্যয় করুন সব থেকে সফল দৃশ্য কল্পনা করার জন্য। অন্যদিকে লোকজন বহির্মুখিতা পছন্দ করে না ফলে নতুন কারো সাথে নিজেকে পরিচয় করানোকে একটা চ্যালেঞ্জ মনে করে।

প্রতি সপ্তাহের শেষে, অংশগ্রহণকারীরা যে চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করেছিল তা সম্পন্ন করেছে কিনা তা জানাত এবং সেইসাথে পুনরায় ব্যক্তিত্ব পরীক্ষাটিতে অংশ নিত। অধ্যয়ন শেষে, তাদের অনেকে ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের লক্ষ্যে এগিয়েছিল। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতাও ধরা পড়েছিল।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, একজন ব্যক্তি যত বেশি ‘চ্যালেঞ্জ’ সম্পন্ন করেছেন, তিনি তত বেশি অগ্রগতি করেছেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বহির্মুখীরা যারা ১৫ সপ্তাহে ৩০টি চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেছেন তারা ২০টি চ্যালেঞ্জ সম্পন্নকারীদের তুলনায় আরো বহির্মুখী হয়েছেন। কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপার হলো তাদের মধ্যে যারা যত স্থিরভাবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে কাজ করেছিল, তারা ততই সফল হয়েছিল।

গবেষকরা তাদের গবেষণা পরিচালনা করার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আবিষ্কার করেন। সেটি হলো একটি মানুষের ব্যক্তিত্ব যেভাবে ধীরে ধীরে উন্নত হতে পারে, ঠিক তেমনি তার অবনতিও হতে পারে। যেমন ধরুন একজন মানুষ যখন সফল হতে থাকে তখন তার ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসে। আর সেই পরিবর্তন হয় ইতিবাচক। কিন্তু যখন একজন মানুষ ব্যর্থ হতে থাকে তখনও তার ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আসতে থাকে এবং তা নেতিবাচক। এক্ষেত্রে ব্যর্থ ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্বকে বদ মেজাজ, অস্থিরতা এবং বিরক্তি—এসব দিয়ে বেষ্টিত করে রাখে।

এই গবেষণার মাধ্যমে কিছু বিষয়কে মাপকাঠি হিসেবে উল্লেখ করা হয় যেগুলো আপনার ব্যক্তিত্বে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মনোবিজ্ঞানীগণ এক্ষত্রে কিছু পরামর্শ প্রদান করেন—
১। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
২। মনোযোগ দিয়ে কথা শোনা। এটা অন্যের কাছে আপনার ব্যাপারে ইতিবাচক বার্তা দেবে এবং আপনিও তার ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানতে পারবেন।
৩। ব্যক্তিত্বের সাথে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিজের জানার পরিধি বিস্তৃত করা।
৪। সবসময় নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করা। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সাথে চলাফেরা করলে আপনার জানার পরিধি কম হবে।
৫। ‘নেতৃত্বদানের ক্ষমতা আসে জন্ম থেকেই’—এই কথাটি সম্পূর্ণভাবে সঠিক নয়। আপনি যদি পেশাগত জীবনে সাফল্য অর্জন করতে চান, তাহলে নেতৃত্বদানের দক্ষতাগুলো বাড়িয়ে তোলা আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
৬। সম্মান এবং প্রশংসা অর্জন করা যায় ঠিক তখনই, যখন আপনি নিজে অন্যকে সম্মান এবং প্রশংসা করবেন। তাই অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলুন।
৭। একজনের কথা অন্যজনের কাছে বলার অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন।

◤ চাইলে আপনি নিজের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করতে পারেন ◢


সামগ্রিকভাবে, এই গবেষণাটি নিশ্চিত করেছে, আপনি আপনার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করতে পারেন। তবে আপনি চাইলেই এটা খুব সহজে পরিবর্তন করতে পারবেন এমন না। এজন্য আপনাকে দিতে হবে যথাযথ গুরুত্ব। উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলোর মধ্যে নিজের ভেতর যেসব বিষয়ের ঘাটতি আছে সেসব ব্যাপারে কাজ করলে ব্যক্তিত্বে নিয়ে আসা যাবে ইতিবাচক পরিবর্তন।

মনে রাখবেন একজন মানুষ আর একজন অমানুষের মধ্যে প্রথম যে পার্থক্য তা হলো পারসোনালিটি বা ব্যক্তিত্ব। একজন মানুষ আর একজন মহামানুষের মাঝেও তাই। বিখ্যাতজনেরা বলে গেছেন, যার ব্যক্তিত্ব কিংবা চরিত্র বলতে কিছু নেই তার মতো দরিদ্র আর কেউ নেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর