কলকাতার মেটিয়াবুরুজে লক্ষ্মৌর সূর্যাস্তের আভা

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:18:06

‘লক্ষ্ণৌর বাদশা কয়েদ থেকে খালাস হয়ে মুচিখোলায় আসায় শহর বড় গুলজার হয়ে উঠলো।’ লিখছেন হুতোম। আদি ও ঔপনিবেশিক কলকাতার বিবরণ সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় আরও বলা হয়েছে, অযোধ্যার সদ্য-রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কোম্পানির পেনশন নিয়ে লক্ষ্ণৌর কোনও প্রাসাদে নিশ্চিন্তে থাকতেই পারতেন। তা না করে ছুটলেন কলকাতা। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী।

নবাবের ইচ্ছা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলের কর্তাদের কাছে সওয়াল করবেন সিংহাসন উদ্ধারের জন্য। সফল না হলে যাবেন লন্ডনে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে দরবার করতে। ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে তাঁর মোহ তখনও কাটেনি। পরিস্থিতির চক্রব্যূহে কোনও কিছুই শেষ পর্যন্ত কাজে এল না, পেনশন নিতে রাজি হয়ে কলকাতাতেই জীবনের বাকি তিরিশটা বছর কাটিয়ে দিলেন ওয়াজিদ আলী।

লক্ষ্ণৌ থেকে সরে গিয়ে তিনি চলে এলেন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার মূল স্রোতের ইতিহাসে। ওয়াজিদ আলি অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জ্বলে উঠল মহাবিদ্রোহের আগুন। তখনও কলকাতায় ভাল ভাবে থিতু হননি ওয়াজিদ আলী, নিতে রাজি হননি পেনশনও। কারণ লন্ডনে তখন ‘আউধ মিশন’ সক্রিয়, তাঁর হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর সহযোগীরা। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাওয়ায় সে গুড়েও বালি পড়ল।

ব্রিটিশ জনমত পুরোপুরি ঘুরে গেল ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। এ দিকে কোম্পানির সরকার হঠাৎ মেটিয়াবুরুজের অস্থায়ী বাসস্থান থেকে গ্রেফতার করল ওয়াজিদ আলীকে। ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একটা তোলা হয়েছিল বটে, তবে তার বিশেষ ভিত্তি ছিল বলে কেউই মনে করেন না। ওয়াজিদ নিজে বিদ্রোহ সমর্থন করেননি, লক্ষ্ণৌয় তাঁর বেগম হজরত মহল ছেলে বিরজিস কদরকে নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও। পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে তুলে ধরে, হয়তো সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা হয় তাঁকে। সেখানে থাকতে হল ২৫ মাস, বিদ্রোহ মিটে যাওয়ারও আট মাস পর তিনি ছাড়া পান। মেনে নেন পেনশনও। এই সময় থেকেই মেটিয়াবুরুজের নবাবির সূচনা।

কলকাতার মেটিয়াবুরুজে রাতারাতি যে ছোট লখনউ গড়ে তুলেছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহ, তাঁর মৃত্যুর পর ততটাই দ্রুততায় তাঁর সব স্মৃতি মুছে ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকার। সে সময়কার নবাবি দফতরের কোনও নথিপত্র রক্ষা পায়নি বললেই চলে, নবাবের লেখা কিছু বই ছাড়া।

অথচ ইংরেজের দেওয়া মাসোহারা-নির্ভর রাজ্যহারা এই নবাব শহরের উপান্তে গড়ে তুলেছিলেন দ্বিতীয় এক লক্ষ্মৌ। অযোধ্যার রাজধানী লক্ষ্মৌর সঙ্গে অবশ্য তুলনা চলে না তার, কিন্তু এখানেও সেই রাজকীয় জৌলুস আর বিলাস। প্রাসাদ, বাগবাগিচা, চিড়িয়াখানা।’ স্বাভাবিক ভাবেই এই পর্বের ইতিহাসের উপাদান সামান্য, তাও ছড়িয়ে রয়েছে মেটিয়াবুরুজ থেকে লক্ষ্ণৌ। এভাবেই তৈরি হয়েছে দুই শহরের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তার রূপরেখা।

পৃথিবীর মানুষের কাছে রাজ্যহারা নবাবের নতুন রাজধানী গড়ার ইতিবৃত্ত ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে। রোজি লিউলিন জোনস তাঁর ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে মেটিয়াবুরুজের ওয়াজিদ আলীকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সরকারি সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে। বিশেষ করে নজরে পড়ে বেগমদের সঙ্গে ওয়াজিদের সম্পর্কের বিষয়টি। রোজি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বাংলা তিনি পড়তে পারেন না। তবে উর্দু নিয়েই ইংল্যান্ডের ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এ স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করার ফলে ওই ভাষার অনেক সূত্র তিনি কাজে লাগাতে পেরেছেন। শ্রীপান্থ সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, হুতোমের মতো বই যে ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, রোজির পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতায় ওয়াজিদ আলির ইতিহাস নতুন করে তৈরি করতে গেলে বাংলা সূত্র বাদ দিয়ে তা করা যাবে না।

আরেক গবেষক সুদীপ্ত মিত্র তাঁর ‘পার্ল বাই দ্য রিভার/ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহজ কিংডম ইন একজাইল’ বইয়ে প্রাক-মেটিয়াবুরুজ পর্বের জন্য প্রকাশিত তথ্যের উপর অনেকটাই নির্ভর করলেও আসল অংশে সমাবেশ ঘটিয়েছেন প্রচুর নতুন তথ্যের, বিশেষ করে তাঁর লক্ষ্য  কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে লক্ষ্ণৌ সংস্কৃতির যোগসূত্র অনুসন্ধান। সুদীপ্ত  জোর দিয়ে বলেছেন, নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার প্রভাব হারায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা রীতিমত দাগ রেখে গিয়েছে। এমন রায় দিয়েছেন উর্দুতে লেখা ‘পুরনো লক্ষ্ণৌ’ গ্রন্থে আবদুল হালিম শরর। নবাবি মেটিয়াবুরুজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত হলেও এত ভাল প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আর দ্বিতীয়টি নেই।

যখন বুঝলেন বাকি জীবনটা কলকাতায় কাটাতে হবে এবং হারানো রাজ্য আর ফিরে পাবেন না, তখনও হতাশ হন নি নবাব। নবাবি ধারা বজায় রেখেই তিনি কাটাতে থাকেন রাজকীয় জীবন। রাজ্য না থাক, মোটা মাসোহারা তো আছে। ফেরত পেয়েছেন রাজকীয় গয়না, মণিমুক্তোও। তাই দিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করলেন। ‘মেটিয়াবুরুজে যেন লক্ষ্মৌর সূর্যাস্তের আভা।’ আসলে মেটিয়াবুরুজের চার দেওয়ালে ঘেরা জগৎ ছিল বাইরের পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ওয়াজিদ আলী (১৮২২-১৮৮৭) যত দিন জীবিত ছিলেন, সেখানে টিকে ছিল মুঘল দরবারি সংস্কৃতির শেষ ছায়া। যে ছায়া খোদ এই সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র দিল্লি থেকে বিদায় নিয়েছিল ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অনেক আগেই। সেটাকেই তিনি ধরে রাখলেন গঙ্গার তীরের কলকাতায়। ছড়িয়ে দিলেন জনসমাজে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর