অন্যদের ভালো-মন্দের বিষয়ে নজরদারি করতেন ছোট্ট রাসেল

, ফিচার

সানজিদা আমীর ইনিসী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট | 2023-09-01 04:13:55

শেখ রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। জন্মগ্রহণ করেন ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ধানমন্ডিতে, ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকরা তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে তাকেও হত্যা করে। তখন তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।

রাসেলের জন্মের সময় শেখ মুজিব ছিলেন চট্টগ্রামে। জন্মের পরপরই বড় ভাইবোনেরা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সবার ছোট হওয়াতে খুব আদরের ছিলেন। রাসেলের যা যা ভালো লাগে, তা করার চেষ্টা করতেন পরিবারের সবাই। বাবাও তাঁর খেয়াল রাখতেন সবসময়। বাসায় ফিরতে দেরি হলে ঘুমন্ত রাসেলের পাশে বসে তাঁকে আদর করতেন। ছোটবেলা থেকেই রাসেল চঞ্চল। বাসা মাতিয়ে রাখতেন।

রাসেলের ছোটবেলা কেটেছে বাবাকে ছাড়া। ১৯৬৪-তে তাঁর জন্মের পর বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বন্দী হয়ে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। অভ্যস্ত হয়েছিলেন মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকেই ‘আব্বা’ বলে সম্বোধনে।

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু রাসেলের কথা বলেছেন। বলেছেন ছোট সন্তানের প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা। রাসেলকে সময় দিতে না পারা বঙ্গবন্ধুকে কষ্ট দিত। সে-কথাও তিনি লিখেছিলেন বইয়ে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফার পর বঙ্গবন্ধু যখন গ্রেফতার হলেন, রাসেল কিছুতেই তাঁকে জেলে রেখে আসতে চাচ্ছিলেন না। বাবার জন্য তাঁর মন খারাপ থাকত। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এসময় তাকে একটি তিন চাকার সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। তাঁর বড় ভাইবোনেরা সবসময় চেষ্টা করতেন তাঁর মন ভালো রাখতে।

শেখ রাসেলের বিচক্ষণতা সকলকে মুগ্ধ করেছিল। পরিবারের সকলের ভালোবাসা পাবার পরেও তিনি টের পেতেন তাঁর বাবার অনুপস্থিতি। বাবার কারাবরণে তাঁর ভালোবাসা হারিয়েছিলেন, এনিয়ে দুঃখও পেয়েছিলেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো।’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!”

◤ পরিস্থিতি ও অনুষ্ঠান বুঝে পোশাক পরতেন ◢


৪ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছিলেন রাসেল। প্রথম-প্রথম কেউ নিয়ে যেতেন স্কুলে। তারপর একাই যাওয়া-আসা করতেন। সহজেই মিশতে পারতেন, অনেক বন্ধু হয়েছিল স্কুলে তাঁর। পড়াশোনায়ও ছিলেন মনোযোগী। নিজের ইচ্ছাতে পড়তে বসতেন, পড়া তৈরি করতেন।

যুদ্ধ শেষ হবার পর এক গৃহশিক্ষিকা রেখে দেওয়া হয় তাঁর জন্য। শেখ হাসিনার বরাতে জানা যায়, শিক্ষিকাকে খুব সম্মান করতেন শেখ রাসেল। খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলেন তাই শিক্ষককে রাসেলের কথা শুনতে হতো নইলে তিনি পড়াশোনায় মনোযোগী হতেন না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলের কথা অনুযায়ীই শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকার খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন শেখ রাসেল। প্রত্যেকদিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকত এবং শিক্ষিকাকে তা খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী।

আত্মীয়স্বজনদের সাথেও তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তাঁর খেয়াল রাখতেন।

বাড়িতে দুষ্টুমি করলেও রাষ্ট্রীয় সফরে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। পরিস্থিতি ও অনুষ্ঠান বুঝে পোশাক পরতেন। প্রিন্স কোট, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী ও মুজিবকোট পরতেন রাসেল। বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরিধানেও মাঝেমধ্যে নজরদারি করতেন ছোট্ট শেখ রাসেল।

শেখ রেহানার বর্ণনামতে জানা যায়, একবার বঙ্গবন্ধু বন্যার্ত এলাকা পরিদর্শনে যাবেন সে সময়ে বঙ্গবন্ধুর পোশাক, পায়ের স্যান্ডেল কী হবে ঠিক করে দিয়েছিলেন শেখ রাসেল। পরিবারের অন্যদের ভালো-মন্দের বিষয়ে নজরদারি করতেন ছোট্ট রাসেল।

শেখ রাসেলের ব্যাপারে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বলেন, “মা বলতেন, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থেকো, তাহলে তোমাকে একটা ছোট্ট বাবু এনে দেব। মার কথামতো লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম কখন মা আমাকে একটা বাবু এনে দেবে। রাসেলের জন্ম হয় অনেক রাতে। আমি ঘুমিয়েছিলাম। আমার মেজফুফু ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, জলদি ওঠো, তোমার ভাই হয়েছে। জন্মের পরে ওকে আমার মনে হয়েছিল একটা পুতুল। কী সুন্দর হাসে, আবার কাঁদেও। রাসেল একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠে। মা ও আব্বা নাম রাখলেন রাসেল। স্কুলের নাম ছিল শেখ রিসালউদ্দীন। হাসু আপা ওকে কোলে করে কত গান শোনাত, কত কবিতা শোনাত। কামাল ভাই আর জামাল ভাইও কোলে নিত। আমিও নিতাম। ভয়ও করতাম যদি পড়ে যায়। যদি ব্যথা পায়। ওর খুব কষ্ট হবে।”

শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবি মওদুদের লেখনিতে আছে, “রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা আব্বার কাছে যাবে না?’ মা কোনো উত্তর দেন না। শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কী মা?’ মা বলেন, ‘কে বলেছে তোমাকে এ কথা?’ রাসেল উত্তর দেয়, ‘সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।”

১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে প্রাণ হারান যখন তখন তাঁর বয়স মাত্র ১১। ঘাতকদের কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, হাসু আপা আর দুলাভাইয়ের কাছে তাঁকে পাঠিয়ে দিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাসায় বসে চিৎকার করে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া ছোট্ট রাসেলকে সবার লাশের সামনে দিয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর