দখলদার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বন-জংগল থেকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছিলেন যে আদিবাসী সাঁওতালরা, দিনে দিনে তারা হয়ে যাচ্ছেন প্রান্তিক ও কোণঠাসা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ঊড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ত্রিপুরা, মিজোরামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রে ছড়িয়ে বসবাসকারী সাঁওতালরা এক বিচ্ছিন্ন জাতিসত্তায় পরিণত হয়েছেন। জমি দখল, উচ্ছেদ ইত্যাদি অর্থনৈতিক আগ্রাসনে বিপন্ন তাদের জীবন।
মহাশ্বেতা দেবীর চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০, ছোটোগল্প সংকলন) যারা পড়েছেন, তারা জেনেছেন সংগ্রামী সাঁওতাল জাতির শৌর্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৫৫ সালে বঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায় সাঁওতালরা ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেন।
ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। এটি ছিল সিপাহী বিদ্রোহের আগের ঘটনা এবং ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। তাদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, চাঁদ, দৈব প্রমুখ।
১৭৯৩ সালে ইংরেজ শাসক লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে স্থানীয় মানুষের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সোচ্চার হয়েছিলেন। সাহস ও সংগ্রামশীলতায় সাঁওতালরা অগ্রণী। সততা, সরলতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় তাদের অরণ্যময় জীবন।
সাঁওতালদের নানা নামে ডাকা হয়। সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর, সাঙ্তাল, সান্দাল, সন্থাল, সান্থাল, সান্তালি, সাতার প্রভৃতি অভিধায়ও অভিহিত হয়ে থাকেন তারা।
সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে, আদি মানব ও মানবী পিলচু বুড়ো (হাড়াম) ও পিলচু বুড়ি সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব। এজন্যই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত, যে গোত্রগুলো ‘পারিস‘ নামে অভিহিত ।
প্রথমে সাতটি আদি গোত্র ও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে মোট বারটি গোত্র হয় । সাঁওতালদের মধ্যে পৌরাণিক কথা, টোটেম, টাবু, লোকবিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রতিটি গোত্র তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা গাছপালা, জীবজন্তু ও পশুপাখী ইত্যাদি নামে পরিচিত। হাঁসদা গোত্রের লোকের বিশ্বাস তাদের উদ্ভব ঘটেছে হাঁস থেকে। তাই হাঁসদা গোত্রের সাওতালদের হাঁস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। আবার সরেন গোত্রের উৎপত্তি হরিণ থেকে তাই তাদের হরিণের মাংস খাওয়া নিষেধ।
ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা অন্যান্য আদিবাসী/নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয়। তাদের ভাষাও অন্য আদিবাসীর চেয়ে আলাদা, অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। সাঁওতালরা মধ্যম গড়নের আকৃতি, ত্বকের গাঢ় রঙ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট এবং কোঁকড়ানো চুলের জন্য অস্ট্রেশীয় নৃতাত্বিক উৎসের প্রতিনিধিত্ব করেন।
এ গোষ্ঠীর মানুষ উপমহাদেশে এসেছিলেন দ্রাবিড়দেরও আগে। তাদের উৎসস্থল অস্ট্রেলিয়া এবং সন্নিহিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপমালা।
ফলে সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও দেহ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সাঁওতালদেরকে বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে মনে করা হয়। তবে অস্ট্রেলীয় কৌমগুলোর সাথে সাঁওতালদের বেশ মিল লক্ষ করা যায় বলে তাদেরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। ধারণা করা হয় সুঁতার (Soontar) কথাটি থেকে সাঁওতাল শব্দের উদ্ভব। সুঁতার বাঙালিদের প্রদত্ত খেতাব।
বাংলাদেশে সাঁওতালরা দিনাজপুর ও রংপুর তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে বাস করে। প্রাচীনকাল থেকেই সাঁওতালরা এদেশে বসবাস করে আসছে। এদের ঘরগুলো ছোট এবং মাটির তৈরি। ঘরে সাধারণত কোনো জানালা থাকে না। সাঁওতালরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। সাঁওতাল পুরুষরা আগে সাদা থান কাপড়ের ধুতি পরতেন। বর্তমানে লুঙ্গি, ধুতি, গেঞ্জি, গামছা ব্যবহার করে। সাঁওতাল নারীরা ‘ফতা‘ নামের দুই খন্ডের কাপড় পরে থাকে। বর্তমানে 'আরা শাড়ি'র ব্যবহার করতে দেখা যায়। পুরুষদের হাতে উল্কির ছাপ দেয়া হয়। মেয়েরা রূপার তৈরি গহনা যেমন, বালা, ঝুমকা, আংটি, মল, হাঁসুলি ইত্যাদি ব্যবহার করে এবং খোঁপায় ফুল গুঁজতে ভালোবাসে।
অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী সাঁওতালি সমাজে যে বিয়ে হয় তাকে সাঁওতালি ভাষায় ‘ডাঙুয়াবাপলা‘ বলে। আগের দিনে মৃতদেহ দাহ করার নিয়ম ছিল। বর্তমানে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সকল এলাকায় সাঁওতালরা মরদেহের কবর দেয়।
ভাত সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য। তবে মাছ, কাঁকড়া, শুকর, মোরগ, খরগোশ এদের খুবই প্রিয় খাবার।
আদিকাল থেকেই কৃষিকে এরা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নারী পুরুষ সবাই জমিতে কাজ করে। পুরুষেরা হালচাষ এবং নারীরা বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজ করে। সাঁওতালরা কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নিজেরা তৈরি করে। শিকার করার ব্যাপারে এদের উৎসাহ খুব বেশি। বাংলাদেশে বন জঙ্গল কমে যাওয়ার কারণে তাদের এই পেশায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে অনেক সাঁওতাল পেশা বদল করে কুলি, মজুর, মাটি কাটার শ্রমিক ও অন্যান্য কাজ করে।
সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে পুত্রদের অধিকার সমান, কিন্তু মেয়েদের কোন অধিকার নেই। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে পিতা প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে গাভী প্রদান করে। পুত্রহীন ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তার সহোদর ভাইয়েরা পেয়ে থাকে।
আরো পড়ুনঃ যেমন কাটছে সাঁওতালদের দিনকাল
সাঁওতাল সমাজে বহিঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। এমনকি উপগোত্রের মধ্যেও বিবাহ হয় না। তাদের সমাজে ছয় প্রকার বিবাহ রীতির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তিন ধরনের বিবাহের প্রচলন দেখা যায়।
সাঁওতালদের পালন করা রীতিনীতি বিভিন্নতা আছে। সাঁওতালী ভাষায় দেবতাকে বলে ‘বোংগা‘। এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে সূর্যদেব। অন্য দেবতাকে বলে ‘মারাং বুরু‘। এর প্রভাব সাঁওতালদের জীবনে সবচেয়ে বেশি। এ দেবতাকে তারা জন্ম-মৃত্যুও কারণ বলে মনে করে থাকে। সাঁওতালদের গৃহদেবতার নাম ‘আবগে বোংগা‘।
সাঁওতালরা খুব আনন্দ প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন পূজাপার্বণ ও সামাজিক উৎসবে এরা নাচ গানে মেতে ওঠে। প্রকৃতির সাথে এদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এরা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে। সাঁওতালদের বার্ষিক উৎসবের নাম ‘সোহরাই‘। এই উৎসবে মেয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচে। শীতের শেষে যখন বনে ফুল ফোটে তখন এরা ‘বাহা‘ উৎসব উদযাপন করে। এদের একটি জনপ্রিয় উৎসবের নাম ‘দাসাই‘। এছাড়াও এরঃ, মাঃ মড়ে, সাকরাত প্রভৃতি উৎসব প্রকৃতির পালা বদলে সাথে সাথে পালন করে থাকে তারা।
সাঁওতালরা নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলে। এদের জীবনযাপন সহজ ও সরল। বর্তমানে সাঁওতালিদের ওপর মূলস্রোতের সমাজের প্রভাব পড়েছে। এদের অনেকে শিক্ষালাভ করে আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। সাওতালদের পালিত অনুষ্ঠানগুলো বেশ আকর্ষনীয়। এরা জাকজমকভাবে নিজেদের অনুষ্ঠানগুলো পালন করে।
প্রকৃতিপ্রেমী, অরণ্যচারী ও চিরায়ত জীবনযাত্রার অধিকারী সাঁওতালরা ক্রমেই অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা হচ্ছে। তাদের অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও খ্রিস্টান মিশনারিরা তাদের ধর্মান্তরিত করছে।একদা সংগ্রামী ঐতিহ্যের জনজাতি এখন বিপন্ন জীবন কাটাচ্ছে নানা প্রতিকূলতা ও পালাবদলের কারণে।