সীমানা থেকে পিচের দূরত্ব কিংবা আউটফিল্ডের গতি—ক্রিকেট মাঠে এসবের পরিবর্তন খেলাটির আবহে নিয়ত যোগ করছে অনন্য মাত্রা। ইতিহাসের সাথে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তিত হয়ে আসছে এসব বিষয়। পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জেস পার্ক-এর কথাই ধরুন। ঐতিহাসিকভাবেই বোলারদের নিরাপদ দুর্গ হিসেবে খ্যাত এই মাঠে ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে ২০০ রানই ছিল বেশ ভালো স্কোর—একসময় যেখানে জর্জ লেম্যান মাত্র ৮ রান খরচে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। কালের পরিক্রমায় সেন্ট জর্জেস পার্কের পিচ এখন ব্যাটসম্যানদেরই বন্ধু। মাঠের এমন পরিবর্তনে ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বা এমসিজিও। নতুন ড্রপ-ইন পিচ তৈরি হওয়ায় স্টেডিয়ামটি ব্যবহার করা যাচ্ছে শীতকালীন ফুটবল আয়োজনেও। তবে এই ড্রপ-ইন পিচের সংযোজন কেড়ে নিয়েছে এমসিজির গতি আর বাউন্স।
একসময় ব্যাটিং স্বর্গ হিসেবে পরিচিত অনেক মাঠই বর্তমানে হারিয়েছে নিজেদের জৌলুস। চলুন দেখে নিই তিন সংস্করণ মিলিয়ে এসময়ের শীর্ষ ৭ ব্যাটিং পিচ।
অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাটসম্যানদের শ্রেষ্ঠ মাঠ হিসেবে বেশ প্রসিদ্ধ অ্যাডিলেড ওভাল। ফ্ল্যাট পিচ আর ছোট বর্গাকার সীমানার এই মাঠে চার-ছক্কার ফুলঝুরিতে দেখা গেছে বহু হাই-স্কোরিং ম্যাচ। অ্যাডিলেড ওভালে উইকেটপ্রতি গড় রান ৩৫.৪৯—কমপক্ষে ৫০ ম্যাচ হওয়া আর কোনো মাঠের নেই এর থেকে বেশি গড়ের রেকর্ড।
এ মাঠের বেশিরভাগ টেস্টই নিষ্পত্তি হয়েছে ড্র-য়ে। এছাড়া ঝোড়ো ব্যাটিংয়ের কিছু টি-টুয়েন্টিও দেখেছে এই মাঠ। সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে অ্যাডিলেড ওভালের গড় ইকোনমি রেট ৮.১৫। ২০টি ডবল সেঞ্চুরির মধ্যে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের অপরাজিত ২৯৯-ই এখন পর্যন্ত এ মাঠের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোর।
১৯৯৬ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজক পাকিস্তানের এই মাঠ অরবিন্দ ডি সিলভার সেই ফাইনাল জেতানো সেঞ্চুরি ছাড়াও দেখেছে আরো অনেক নান্দনিক ইনিংস। টেস্ট ম্যাচগুলোয় লাহোরের এই গ্রাউন্ডে উইকেটপ্রতি গড় রান ৩৪.৯৯—ফলাফলস্বরূপ ৫৫ শতাংশ ম্যাচই হয়েছে ড্র। নয়টি ডবল সেঞ্চুরির পাশাপাশি কিউইদের বিরুদ্ধে ইনজামাম-উল-হকের অবিস্মরণীয় ৩২৯ রানের সাক্ষী এই গাদ্দাফি স্টেডিয়াম।
জহির আব্বাস, মোহাম্মদ ইউসুফদের মতো গ্রেটরা ৯০ ব্যাটিং গড় নিয়ে মাতিয়েছেন গাদ্দাফির গ্যালারি। তবে বীরেন্দর শেবাগের ২৪৭ বলে ২৫৬ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটির কাছে হার মেনেছে অন্য সব পারফরমেন্স। পাকিস্তানের ৬৭৯ রানের জবাবে সে ম্যাচের একমাত্র ইনিংসে শুধু শেবাগের উইকেটটি হারিয়ে ৪১০ রান তোলে ভারত।
উইকেটপ্রতি ৩৩.৫৪ গড় রান আর মাত্র ৫.২৪ ইকোনমি রেট—বেশ ভালো পরিসংখ্যান রয়েছে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে আয়োজিত একদিনের ম্যাচগুলোরও। শোয়েব মালিকের ঝোড়ো সেঞ্চুরির সৌজন্যে অতিসম্প্রতি এখানে ৩৭৫ রানের স্কোর গড়েছিল পাকিস্তান। মজার ব্যাপার, এই ভেন্যুতে ৫৪.২১ গড় আর ৯৬.২৬ স্ট্রাইক রেটে এক হাজারেরও বেশি রান রয়েছে মালিকের।
টেস্টে উইকেটপ্রতি ৩৫.৭৩ গড় রান আর ওয়ানডেতে ৩৬.৩৭ গড় রান নিয়ে গাদ্দাফির পরেই আসে ভারতের গ্রিন পার্কের নাম। এ মাঠে আয়োজিত অর্ধেকেরও বেশি ম্যাচ নিষ্পত্তি হয়েছে ড্র-য়ে। এক জায়গায় অবশ্য মিল আছে গাদ্দাফি আর গ্রিন পার্কের—দুই মাঠই দেখেছে ব্যক্তিগত ১৯৯ রান নিয়ে আউট হবার বেদনাদায়ক দৃশ্য। ঘরের মাটিতে ইউনিস খানের পর ভারতের কানপুরের এ মাঠে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় মোহাম্মাদ আজহারউদ্দিনের হাতে। তবে কপিল দেবের সাথে আজহারউদ্দিনের সেই ২৭২ রানের পার্টনারশিপ এখন পর্যন্ত এই ভেন্যুতে সর্বোচ্চ।
নড়বড়ে নব্বই নয়, বরং নড়বড়ে নব্বই-ই যেন বেশ ভীতিকর এ মাঠে খেলা ব্যাটসম্যানদের জন্য। আজহারউদ্দিন ছাড়াও আরো দুজন কিংবদন্তি—গ্যারি সোবার্স আর গর্ডন গ্রিনিজ কাটা পড়েছেন ডবল সেঞ্চুরি থেকে হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকে। তবে ওডিআইতে রোহিত শর্মার ১৫০ ও ১৪৭ রানকে টেক্কা দিতে পারেননি আর কেউই।
২০০৭ বিশ্বকাপের সময় প্রভিডেন্স স্টেডিয়াম নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে কয়েক ধাপ নিচে নেমে শুধুমাত্র ঘরোয়া ক্রিকেটের ভেন্যু হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে গায়ানার বোর্দা স্টেডিয়াম। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটহীন এই মাঠ একসময় উপহার দিয়েছে মনে রাখার মতো অনেক দুর্দান্ত ম্যাচ।
এ মাঠে আয়োজিত ১১ ওডিআইয়ের দুটিই হয়েছিল টাই। যার প্রথমটি হয় ১৯৯৩ সালে—কার্ল হুপারের অপরাজিত ৬৯ রানের সুবাদে পাকিস্তানের করা ২৪৪ তুলেই থামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ—দুদলের বোলিং ডিপার্টমেন্টের কথা চিন্তা করলে নব্বই দশকের শুরুতে অমন ওডিআই স্কোর বেশ ভালোই বলা চলে। বোর্দায় আয়োজিত টেস্টগুলোয় উইকেটপ্রতি গড় রান ছিল ৩৬.২২, আর ওয়ানডেতে ৩৩.৭২। কমপক্ষে ৩০ টেস্ট হয়েছে, এমন আর কোনো মাঠেই এর থেকে বেশি উইকেটপ্রতি গড় রান নেই। এখানে ১২৬.৩৩ গড়ে সাত ম্যাচ খেলেছেন কিংবদন্তি শিবনারায়ণ চন্দরপল। গ্যারি সোবার্স আর রিচি রিচার্ডসন—বোর্দায় দুজনেরই গড় রান ৯০।
সুইং বোলিংয়ের আদর্শ মঞ্চ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের সবুজাভ পিচ আর গুমোট আবহাওয়া ফুল-লেন্থের বোলারদের সহায়তা করেছে সবসময়। তবে টেস্টে নেপিয়ারের ম্যাক্লিন পার্কের উইকেটপ্রতি গড় রান ৩৮—কমপক্ষে ১০ টেস্ট হওয়া কোনো মাঠের হিসেবে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ! ম্যাক্লিনে আয়োজিত ১০ টেস্টের ৭টিই শেষ হয়েছে ড্র-য়ে।
এ মাঠে ফল বের করা কতটা কঠিন, ২০০৯ সালে তা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে নিউজিল্যান্ড ও ভারত। জেসি রাইডারের ক্যারিয়ার-সেরা ২০১ রানের সাথে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম এবং রস টেলরের সেঞ্চুরি নিয়ে প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৫৪.৪ ওভারে ৬১৯ রান তোলে কিউইরা। রাহুল দ্রাবিড়ের ৮৩ রানে ভর করে ৩০৫-এ থমকে যায় ভারতের ইনিংস। তবে ভেট্টরি-ও’ব্রায়েনদের ঘূর্ণির সামনে ফলোঅনে পড়া ভারত সবাইকে চমকে মাত্র ৪ উইকেট হারিয়ে তোলে ৪৭৬ রান।
১০ নম্বরে নেমে অভিষিক্ত টিম সাউদির ৪০ বলে ৭৭ রানের বিধ্বংসী ইনিংসটিও এসেছে এই মাঠেই। ২০০৮ সালের সে ম্যাচে নয়টি ছক্কা হাঁকানো সাউদির নিউজিল্যান্ড অবশ্য হেরে যায় ১২১ রানে।
ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য নাগপুরের বিদর্ভই খুব সম্ভবত সবচেয়ে সেরা মাঠ। মাত্র ১৪ ওয়ানডে আর ৯ টেস্টের আয়োজক বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গ্রাউন্ডের রয়েছে বেশ চমকপ্রদ পরিসংখ্যান। এ মাঠে টেস্টে উইকেটপ্রতি গড় রান ৩৭.২৮, আর ওয়ানডেতে ৩৬.৫৭—সমান সংখ্যক ম্যাচে এর থেকে বেশি গড় নেই আর কোনো মাঠেরই। এর থেকেও মজার তথ্য—ওডিআইতে এ মাঠে ওভারপ্রতি গড় রান ৫.৭১!
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৯ সালে বিদর্ভের পিচ নতুন করে বিছানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিসিসিআই। তাতে পাল্টায়নি চিত্র—পরের বছর শচীন টেন্ডুলকার আর অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ডবল সেঞ্চুরির সৌজন্যে হাই-স্কোরিং ড্র-য়ে নিষ্পত্তি হয় ভারত ও জিম্বাবুয়ের মধ্যকার টেস্টের। এ গ্রাউন্ডে ৬ ম্যাচ খেলে ৯৭ গড়ে ৬৭৯ রান করেছেন ভারতের লিটল মাস্টার। এমনকি বিদর্ভে স্পিনার অনিল কুম্বলেরও রয়েছে তিন-তিনটি অর্ধশতক!
এই স্টেডিয়ামে শেষবারের মতো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় ২০০৭ সালে। ভারতের বিপক্ষে সেই ওয়ানডেতে ৩৩৮ রানের লক্ষ্যে মাত্র ১৪ রান বাকি থাকতে থামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বৃথা যায় চন্দরপলের ১৪৯ রানের কাব্যিক ইনিংস।
২২ টেস্টে উইকেটপ্রতি ৩৮.১৭ গড় রানের পরিসংখ্যানই বলে দেয় ব্যাটিং স্বর্গের তালিকায় অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের অবস্থান। সমতল পিচের এই গ্রাউন্ডকে তাই প্রায়শই বলা হয় ‘পালকশোভিত বিছানা’।
বর্তমান সময়ের যে কোনো বোলারের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর মানেই তৃপ্তিকর অভিজ্ঞতার হাতছানি। বলা বাহুল্য, অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে আবারও আন্তর্জাতিক ম্যাচের আয়োজন হলে দৃশ্যটি একটু অন্যরকমই হতো। ২০০৪ সালে এই মাঠেই ১৬ বছরের মধ্যে প্রথম অ্যাশেজ জেতা ইংল্যান্ড বোলিং লাইনআপের বিরুদ্ধে ক্যারিবিয়ান গ্রেট ব্রায়ান লারা গড়েন টেস্টের সর্বোচ্চ ইনিংসের বিশ্বরেকর্ড। অপরাজিত ৪০০ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস শেষে দলীয় সংগ্রহ ৭৫১-এ ইনিংস ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন লারা। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এ মাঠেই ১৯৯৪ সালে ৩৭৫ রানের ম্যারাথন ইনিংস খেলেন তিনি।
অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে ২০০৫ সালে সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩১৭ রান করেন ক্রিস গেইল—যাকে থামাতে দলের ১১ জনই বাইশ গজে নেমে পড়েন বল হাতে। মাত্র ১৭ উইকেটের বিনিময়ে সে ম্যাচে দুদলের সম্মিলিত স্কোর দাঁড়িয়েছিল ১৪৬২ রান।
জয়ের জন্য সর্বোচ্চ লক্ষ্য সফলভাবে তাড়া করার রেকর্ড ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে এ মাঠেই। চন্দরপল ও সারওয়ানের ২১৪ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিতে প্রায় ১৫ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার ৪১৮ রানের লক্ষ্য তিন উইকেট হাতে রেখে পার করে ফেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এর আগে ১৯৮৬ সালে এই অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে টেস্টের দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন ভিভ রিচার্ডস। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর সেই ঝোড়ো শতক আসে মাত্র ৫৬ বলে।
ত্রিশ বছরে বহু রেকর্ড ভাঙা-গড়ার পর এই গ্রাউন্ডে আয়োজিত উত্তেজনায় ঠাসা শেষ টেস্টে উইন্ডিজদের জয়ের জন্য ৫০৩ রানের টার্গেট দেয় ইংল্যান্ড। অনেক দূর গিয়েও শেষ পর্যন্ত অ্যান্ডারসন-ব্রড-হার্মিসনদের বোলিং লাইনআপ পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয় ক্যারিবিয়রা, শেষ উইকেট হাতে নিয়ে ৩৭০ রানে শেষ হয় তাদের লড়াই।