রডোডেনড্রন প্রেমিক এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী

, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 11:04:13

হিমালয়ের উঁচু-নিচু ভূগোলে, পাকদণ্ডীর বাঁকে বাঁকে শত শত বছর ধরে হেলায় জন্ম-মৃত্যু হয়েছে শত শত রডোডেনড্রন পুষ্প ও প্রজাতির। বিলাত থেকে আসা এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রেমে পড়েন এই ফুলের। অশেষ কষ্ট স্বীকার করে পরিচালনা করেন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা। পুষ্পের ইতিহাসে অনামা এই ফুলটি অবশেষে বিজ্ঞানীর হাত ধরে পেল একটি সুন্দর নাম আর সম্মানজনক আসন।

তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালের শেষভাগ। মহারানির অধীনে ব্রিটিশরাজের শাসন তখনো শুরু হয় নি ভারতবর্ষে। সেই ঘোরতর সন্ধিক্ষণে একজন ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী স্বদেশের হাজার মাইল দূরের অচেনা হিমালয়ের গহীন-গভীরে খুঁজে খুঁজে বের করেন রডোডেনড্রনের অসংখ্য ভেরাইটি এবং ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের মাটিতে ছড়িয়ে দেন ভালো লাগা ও ভালোবাসার প্রিয় ফুলটিকে।

ঘটনাটি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭) দশ বছর আগেকার (১৮৪৭) সালের কথা। রডোডেনড্রন নামটি তখনো পযন্ত কেউ জানতেন না। সে সময় জোসেফ ডালটন হুকার নামের ত্রিশ বছর বয়েসি ইংল্যান্ডের এক তরুণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী সমুদ্র জাহাজে পাড়ি দিলেন সম্পদে ভরপুর উপনিবেশ ব্রিটিশ-বাংলার পথে। সবাই যখন বাংলার সম্পদ আহরণ করে বিলাতে ধনী হতে মশগুল, তখন এই তরুণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী চাইলেন পাহাড়-পর্বত ঘুরে ঘুরে জীববৈচিত্র্যের সন্ধান করতে।

শাশ্বত বাংলার অর্থনৈতিক সম্পদ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা তাকে আকৃষ্ট করল না, আকৃষ্ট করল চিরায়ত প্রকৃতি ও পরিবেশ। তিনি আগ্রহী হলেন প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সুষমার অনুসন্ধান কাজে। তাঁর ভ্রমণ পরিকল্পনায় সে কারণে বাংলা বা ভারতের শহর কিংবা বাণিজ্যকেন্দ্র নেই। প্রকৃতিকে সরাসরি জানতে এবং প্রাণ ভরে দেখতে তিনি তাঁর গন্তব্য ঠিক করেন অখণ্ড বাংলার উত্তরবঙ্গ, আসাম, সিকিম, নেপাল আর তিব্বত। শহরের চেয়ে বহুদূরের অরণ্য-পাহাড়ের পটভূমিকায় ছড়িয়ে থাকা ‍সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালার পূর্বাঞ্চলের অপরূপ-প্রকৃতিসমৃদ্ধ অঞ্চল ও জনপদ এই তরুণ বিজ্ঞানির পছন্দের জায়গা।

ঔপনিবেশিক শক্তির পেছন পেছন আলোকিত ইউরোপ থেকে নানা বিদ্যায় পারদর্শী জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞানীরা তখন অল্প অল্প করে ব্রিটিশ-বাংলায় আসতে শুরু করেছেন। কেউ চান নতুন দখলকৃত অঞ্চলে নিজেদের খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করতে। কেউ চান ছাপাখানা স্থাপন করে বইপত্র, পত্রিকা, ব্যাকরণ চর্চা করতে। এশিয়াটিক সোসাইটর মাধ্যমে অনেকে দলবদ্ধ হয়ে শুরু করলেন ভারতচর্চা। এদের বলা হতো ওরিয়েন্টালিস্ট, যারা প্রাচ্যের প্রাচীন বিষয়কে আধুনিক ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করতেন। প্রাচীন মন্দির, স্থাপনা, ক্ষেত্র অনুসন্ধানে এলেন প্রত্নতাত্ত্বিকগণ এবং বিচিত্র সংস্কৃতির সন্ধানে নৃবিজ্ঞানিরা।

এইসব কৃতবিদ ইউরোপীয়দের হাতে ভারত নবরূপ লাভ করতে থাকে। ধীরে ধীরে জন্ম নেয় আধুনিক ভারতের আদি কাঠামো। রেনেসাঁর-পূর্ব-পুরুষ রূপে প্রণোদনা জাগাতে লাগলেন নানা ক্ষেত্রের নানা গুণীজন। প্রাচীন ভারত জেগে উঠল এইসব বিদেশিদের স্পর্শে। উপনিবেশবাদের তীব্র শোষণ ও অন্ধকারের মধ্যেও মানব মনীষার ছোঁয়ায় জ্বলে উঠলো কিছু কিছু আলো।

জোসেফ ডালটন হুকার নিজের নাম যুক্ত করলেন সেই আলোকিত মানুষদের আদি তালিকায়। হিমালয়ান উদ্ভিদ, গুল্ম, লতা-পাতা-পুষ্প অনুসন্ধানে তার অবদান চিহ্নিত হলো ইতিহাসের পাতায়। বিশেষত রডোডেনড্রনের সুবাদে তিনি রইলেন অমর হয়ে।

ইতিহাস ভোলেনি, ইংল্যান্ড বা ব্রিটিশ-বাংলাও ভোলেনি নিবেদিতপ্রাণ উদ্ভিদবিজ্ঞানীকে। হুকারের স্মরণে দার্জিলিঙ-এ আছে ‘হুকার রোড’, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলে বাঁ দিকে অনেক দূর চলে গেছে আঁকাবাঁকা সেই রাস্তা, হুকারের কণ্টাকীর্ণ-সংগ্রামী জীবনেরই মতো সর্পিল এবং উত্থান-পতনে ভরপুর।

আরো পড়ুন: বিশ্বায়নের দূত রডোডেনড্রন

এ সম্পর্কিত আরও খবর